ই-অরেঞ্জসহ ১২ প্রতিষ্ঠানে প্রতারণার শিকার গ্রাহকরা, টাকা ফেরত পাবেন কিভাবে
মো. আখতারুজ্জামান : ই-কমার্স খাতে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হতে নিত্য নতুন প্রতারণার ফাঁদ পাতছে বেশকিছু কোম্পানি। প্রতিনিয়ত প্রতারণার তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন কোম্পানি। প্রথম আলোচনায় আসে ইভ্যালির প্রতারণা। এর পর একে একে যুক্ত হয় ১২টি কোম্পানির নাম। যারা সাধারণ মানুষকে অফারের লোভে ফেলে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়। নতুন করে যুক্ত হয়েছে ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করা রিং আইডি। মনিটরিং না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে প্রতারণা ঠেকাতে এই খাত পর্যবেক্ষণের জন্য পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রতিরিত প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জেলে থাকায় পণ্য বা অর্থ পাওয়া নিয়ে আঙ্কায় আন্দোলন করছে গ্রাহকরা।
প্রতারণা করছে রিং আইডি। এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীরা বিনামূল্যে ভয়েস ও ভিডিও কল, মেসেজিং ও গোপন চ্যাটিং করতে পারে। এখানে সোশ্যাল কমার্স নামে গ্রাহকদের কাছে পণ্য বিক্রি করা যায়। এসব পণ্যের দাম বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি কানাডায় নিবন্ধিত হলেও এর প্রায় সব কার্যক্রম বাংলাদেশ ঘিরে। জানা যায়, রিং আইডি এরই মধ্যে গোল্ড ক্যাটাগরিতে চার লাখ ব্র্যান্ড প্রমোটার নিয়োগ দিয়ে ৮৮০ কোটি টাকা তুলেছে। পাশাপাশি এজেন্টসহ অন্যান্য ক্যাটাগরিতে আরও অন্তত ২০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।
অন্যদিকে, প্রতাণার পথে হাটছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকম ডটকম। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের পণ্যের সরবরাহ না করেই অফিস বন্ধ ঘোষাণা করেছে। যদিও দুই ধরণের তথ্য দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি জনসংযোগ কর্মকর্তা জানিয়েছেন গ্রাহকের চাপে অফিস বন্ধ রেখে ৫ হাজারের বেশি গ্রাহদের পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। আগামী শনিবার থেকে অফিস খোলা হবে। আবার অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক আইডিতে বলা হয়েছে, আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিউকমের সকল ফিজিক্যাল সাপোর্ট বন্ধ থাকবে। সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা হোম অফিসের মাধ্যমে সেবা প্রদান করবেন।
কিউকম ডটকমের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরজে হুমায়ুন কবির নিরব জানান, আমরা গ্রাহকদের চাপ সামলাতে কিছুদিন অফিস বন্ধ রেখেছি। ৫ হাজারের বেশি গ্রাহরা ২০০ কোটি টাকার বেশি পণ্য ক্রয়ের আদেশ দিয়েছে। এটা সরবরাহ করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। আশা করছি দু-একদিনের মধ্যে এই পণ্যে দেয়া শেষ হয়ে যাবে। আগামী শনিবার থেকে অফিস খোলা হবে বলে তিনি জানান।
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকারে বাজার ব্যবস্থাপনা কত দুর্বল তারি চিত্র ফুটে উঠছে ই-কমার্স খাতে। সঠিক পর্যবেক্ষণ না থাকায় এটা হয়েছে। সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে এরা পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে টাকা নিয়ে বিনিয়োগ করে অন্য খাতে। এটা আমাদের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী।
তিনি বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যবসা করতে না পারে সরকারকে এ বিষয়ে কঠো পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এ প্রতারণার জাল থেকে গ্রাহকদের রক্ষার জন্য দরকার ই-কমার্স অথরিটি। সম্প্রতি যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আর প্রতিষ্ঠানগুলো এটা পরিপালন করতেছে কিনা না পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
ই-কমার্সের মাধ্যমে দেশে যে প্রতারণা চলছে এ বিষয়ে বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ই-কমার্স ব্যবসায় সাম্প্রতিক সমস্যা নিয়ে পর্যালোচনা এবং এ বিষয়ক নীতিনির্ধারণী সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে, ই-কমার্স ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন এবং খাতটির সুষ্ঠু পরিচালনায় ডিজিটাল ই-কমার্স অ্যাক্ট নামে একটি স্বতন্ত্র আইন করা হবে।
সভায় শেষে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান, ই-কমার্স খাতে যে প্রতারণা ঘটেছে তার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কীভাবে ব্যবস্থা নেয়া যায়। সেইসঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতারণা বন্ধে করণীয় কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ আলোচনায় অংশীজনদের থেকে কেউ কেউ বলেছেন ই-কমার্স খাত বন্ধ করে দিতে। তবে সর্বসম্মতভাবে আলোচনায় তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। কারণ দেশের ই-কমার্স খাতে এখন তৈরি হয়েছে ক্রমবর্ধমান ও সীমাহীন সম্ভাবনা। ১০ থেকে ১২ প্রতিষ্ঠানের জন্য লাখ লাখ উদ্যোক্তার দায় বহন করবে কেন?
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম জানান, প্রতিযোগিতা কমিশনের কাজ হচ্ছে বাজারে অসাভাবিক প্রতিযোগিতা হচ্ছে কি না দেখা দেখভাল করা। কোনো কোম্পানি যদি অস্বাভাবিক কম বা বেশি দাবে পণ্য ক্রয় বিক্রয় করলে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। গত বছর ইভ্যালির বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ দায়েক করে অস্বাভাবিক অফার বন্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ই-কমার্স খাতে প্রতারণা মূলত সরকারের রেগুলেটরি বডিগুলোর দুর্বলতার কারণে হয়েছে। এটা যাদের দেখভালের দায়িত্ব ছিলো তারা যথাযথভাবে তাদের কাজ করেনি।
তবে প্রতারণার বিষয়ে ক্রেতাদেরও দায়িত্ব রয়েছে জানিয়ে তিনি জানান, একটি মোটরসাইকেল কিভাবে প্রচলিত বাজারের চেয়ে অর্ধেক দামে দেয় এটা ক্রেতাদের ভাবতে হবে। একটি পণ্য ক্রয়ের ২১ বা ৪৫ দিন পর পাবে কেন এটা একবারও ভাবনায় আসে না ক্রেতাদের?
এদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেলের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানার অর্থ আত্মসাতের নতুন মামলায় রিমান্ড ও জামিন নামঞ্জুর করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. হাসিবুল হকের আদালত এ আদেশ দেন।
বৃহস্পতিবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আবুল কালাম আজাদ আসামিকে আদালতে হাজির করে গ্রেপ্তারের আবেদনসহ ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তার বিরোধিতা করা হয়। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত রিমান্ড ও জামিন নামঞ্জুর করে আসামিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে একদিন জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন।
অপরদিকে, বিনিয়োগ করা টাকা ফেরত ও ই-অরেঞ্জের মূল হোতা সোহেলকে দেশে আনার দাবিতে সড়ক অবরোধ করার চেষ্টাকালে পুলিশ লাঠিচার্জ করে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে হাইকোর্ট থেকে মৎস্য ভবনের দিকে যাওয়ার সড়কের এ ঘটনা ঘটে। কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।
ডিএমপির রমনা বিভাগের ডিসি সাজ্জাদুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস। এমনিতেই যানবাহনের চাপ বেশি থাক। এরমধ্যে তারা সড়ক অবরোধ করেছিল। আমরা তাদের সড়ক থেকে সরিয়ে দিয়েছি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২/৩ জনকে থানায় নেওয়া হয়েছে। সম্পাদনা : ভিকটর রোজারিও