বিসিকের দুর্বলতায় তিন বছরে এক কোটি ৬৪ লাখ ঘনমিটার বর্জ্য নদীতে গেছে
মো. আখতারুজ্জামান : চামড়া শিল্পের উন্নয়ন ও এখাতের বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধানের লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে চামড়া শিল্প কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়াই বিসিককে সাভারের ট্যানারি শিল্প তৈরি দায়িত্ব দেয়া ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো।
শুরু থেকেই অভিজ্ঞ জনবল নিয়ে আলাদা কোনো কর্তৃপক্ষ গঠন করা হলে আজ এ অবস্থার তৈরি হতো না। ট্যানারি ব্যবসায়ীরা বিসিকের পর্যবেক্ষণের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলে আসছিলেন। যদিও সেই সময়ে বিসিকের পক্ষ থেকে বলা হয়ে ছিলো যে তারা যথাযথাভাবে দায়িত্ব পালন করছে।
বৃহস্পতিবার চামড়া শিল্পখাতের উন্নয়নে সুপারিশ প্রদান ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ণের লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্সের ৪র্থ সভায় পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব করা হয়।
সভায় টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক ও শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের সভাপতিত্বে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা, বিসিক চেয়ারম্যান মোশতাক হাসান এনডিসি, রাজউক চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন, ট্যানারি শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় শিল্পমন্ত্রী বলেন, চামড়া শিল্পখাত একটি বৃহৎ শিল্প। চামড়া রপ্তানির জন্য বিদেশে নতুন বাজার খুঁজতে হবে। চামড়া ব্যবসায়ীদের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এজন্য সরকার সবরকম সহযোগিতা করবে। সভায় গত ২৮ আগস্ট অনুষ্ঠিত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় সাভারের চামড়া শিল্পনগরী বন্ধের সুপারিশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
শিল্পমন্ত্রী বলেন, আমরা ট্যানারি শিল্পনগরী বন্ধ করার পক্ষে নই। আমাদের কাঁচামাল আছে। জনশক্তি আছে। অভিজ্ঞতা আছে। কাজেই শিল্পনগরীর চামড়া কারখানাগুলোর সুষ্ঠু উৎপাদন কার্যক্রমের স্বার্থে পরিবেশগত ছাড়পত্রের নবায়ন ত্বরান্বিতকরণ, সিইটিপি কার্যকর করা, আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগের পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী সভায় ভার্চুয়ালী সংযুক্ত হয়ে বলেন, আমরা চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে বিলিয়ন ডলার আয় করতে চাই। সে লক্ষ্যে কাজ করছি।
পরিবেশমন্ত্রী বলেন, সাভারে ২৫ হাজার ঘনমিটার তরলবর্জ্য শোধনের ক্ষমতা থাকলেও উৎপাদন হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য। এতে নদীর পানি দূষণ হচ্ছে। আমাদের যৌথভাবে সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন করতে হবে।
শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার সভায় কোরবানির ঈদে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক চামড়ার যে মূল্য নির্ধারণ করেছে, প্রান্তিক পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা যথাযথ মূল্য কেন পাননি। যার জন্য তারা মাথায় হাত দিয়ে বসে গেছে এজন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল।
চামড়ার মূল্য এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাজার ধরার জন্য দুই মন্ত্রণালয়ের টানাটানি না করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের একক সিদ্ধান্ত থাকা প্রয়োজন। শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা কেন্দ্রিয়ভাবে চামড়া মজুদ ও সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বারোপ করেন।
গত ২৩ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভবনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না করায় সাভারের ট্যানারি কমপ্লেক্স বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়। কমিটির পক্ষ সুপারিশ করা হয়, তবে যথাযথভাবে পরিচালিত হলে পুনরায় চালু করার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। বন্ধের আগ পর্যন্ত জরিমানার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুপারিশও করে সংসদীয় কমিটি।
২৩ আগস্ট সভা শেষে কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, চামড়া শিল্পনগরী পরিদর্শন করে সার্বিক অবস্থা দেখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে দৈনিক ৪০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদন হয়। অথচ সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা রয়েছে ২৫ হাজার ঘনমিটার। অর্থাৎ দৈনিক ১৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পরিবেশে মিশছে। গত তিন বছরে এক কোটি ৬৪ লাখ ঘনমিটার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বাইরে থেকে গেছে।
সাভারের চামড়া শিল্প নগরী বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এই সুপারিশ প্রত্যাহারের দাবিতে গত ২১ সেপ্টেম্বর সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীতে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন ট্যানারির কয়েক শ্রমিকরা। তাদের দাবি কারখানা বন্ধ করে দিলে ৬ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়ে পথে বসবে।
২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার কাজে হাত দেয় বিসিক। হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকদের অনীহা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের এপ্রিলে আদালতের নির্দেশে তাদেরকে সেখানে যেতে বাধ্য হতে হয়। শুরুতে কথা ছিল শিল্পনগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ট্যানারিগুলো নিজেরাই ইটিপি স্থাপন করবে।
শিল্প মন্ত্রণালয় প্রকল্পের আওতায় সিইটিপি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০১০ সালে প্রকল্প সংশোধন করা হয়। তখন প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ৫৪৫ কোটি টাকা। উচ্চ আদালত হাজারীবাগের কারখানাগুলোর গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আদেশ দেওয়ার পর ২০১৭ সালের এপ্রিলে কারখানাগুলো একযোগে স্থানান্তরিত হয়। সম্পাদনা : ভিকটর রোজারিও