স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতিবেদন ২০২১ দারিদ্রের হার শূন্যে নামিয়ে আনতে ব্যয় করতে হবে ৮,৬০০ কোটি ডলার
সোহেল রহমান : স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে সহজ উত্তরণ ও কাঠামোগত স্থানান্তর টেকসই ও নিশ্চিত করতে হলে কিছু বিষয়ে বাংলাদেশকে কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক সুবিধা হারাবে। এমতাবস্থায় স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পাওয়া আন্তর্জাতিক সুবিধাগুলো বন্ধ হওয়ার আগেই বাংলাদেশকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
ইউনাইটেড নেশন্স কন্ফারেন্স অন্ ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট (আঙ্কটাড)-এর সদ্য প্রকাশিত দ্য লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রিজ রিপোর্ট ২০২১ (স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতিবেদন ২০২১) শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সোমবার রাতে এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের প্রাক-উত্তরণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ছয়টি সুপারিশ করে বলা হয়েছে, এলডিসি থেকে উত্তরণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, পণ্য বহুমুখীকরণ, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। এছাড়া একটি কার্যকর শিল্পনীতিও প্রণয়ন করা দরকার।
অন্যান্য সুপারিশমালার মধ্যে রয়েছে- কর প্রশাসন ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ শক্তিশালী করা এবং রাজস্ব আয় বাড়াতে ব্যবসা পরিবেশ ও বিনিয়োগ সহজ করা; জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা ও ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা, যা যোগাযোগ ও সংশ্লিষ্ট খাতে দক্ষতা বাড়াতে সহায়ক হবে; শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য সহায়ক মানব সম্পদ উন্নয়নে টেকসই বিনিয়োগ করা; প্রযুক্তিগত উন্নয়নে সহায়তা প্রদান এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-উদ্ভাবনী সংশ্লিষ্ট ইকোসিস্টেমের উন্নয়ন, সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে আন্ত:যোগাযোগ ও অবকাঠামো ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনী ব্যবসা কৌশলকে সহায়তার মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন অব্যাহত রাখা; উৎপাদন ক্ষমতা এবং স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতা বাড়াতে একটি কার্যকর শিল্পনীতি প্রণয়ন করাÑ যা বাজার দুর্বলতা কমিয়ে আনার পাশাপাশি অর্থ্যনতিক সংযোগগুলোকে শক্তিশালী করবে। এছাড়া পণ্য বৈচিত্র ও বহুমুখীকরণের ওপরও বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলডিসি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ তিনটি সূচকেই এগিয়ে রয়েছে। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের সূচকে নির্ধারিত মান হলো ১ হাজার ২৩০ ডলার। বাংলাদেশের আছে ১ হাজার ৬৪০ ডলার। মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে নির্ধারিত মান হলো ৬৬ থেকে তার বেশি। বাংলাদেশের আছে ৭৫। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে নির্ধারিত মান হলো ৩২ থেকে কম। বাংলাদেশের আছে ২৭।
প্রতিবেদনে জাতিসংঘ ঘোষিত আগামী ২০৩০ সাল নগাদ ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) অর্জন প্রসঙ্গে বলা হয়, এসডিজি বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। করোনার কারণে এসব খাতের অবস্থা নাজুক।
এসডিজি’র এর প্রথমটি হলো দারিদ্রের হার শূন্যে নামিয়ে আনা। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশকে ৮ হাজার ৬০০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে। করোনা মহামারির কারণে নতুন করে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকেই দারিদ্র বিমোচনে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে।
এছাড়া বাংলাদেশের উৎপাদনশীলতার এখন যে সক্ষমতা আছে, এটিকে দ্বি-গুন করতে হলে আগামী ১০ বছরে আরও ২৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার ব্যয় এবং গড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে শোভন কাজ ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি খাতে আগামী ১০ বছরে ১১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে, যা মোট জিডিপির ৩১ শতাংশ।
প্রতিবেদন প্রকাশকালে আঙ্কটাড-এর অর্থনীতি বিষয়ক কর্মকর্তা জিওভানি ভ্যালেন্সিসি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের উপর বেশি পরিমাণে নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক পদক্ষেপগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ হলেও যাতে অগ্রগতি থেমে না যায়, সেজন্য শিল্পের নীতি কাঠামো তৈরি করা দরকার। বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি করলেও এখনও মাথাপিছু জিডিপি বৈশ্বিক গড়ের মাত্র ১৫ শতাংশ। এক্ষেত্রেও বড় পরিসরে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
সিপিডি’র অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এলডিসির অগ্রাধিকার সুবিধাগুলো হয়ত থাকবে না, কিন্তু অনুদান যেটা দেয়া হবে, তা বেশি উৎপাদনসক্ষম খাতে দেয়া যেতে পারে। জিডিপি-তে উৎপাদন খাতের অবদান দ্বি-গুন করতে হলে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ দরকার হবে। আর বৈষম্য দূর করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে কৌশলগত জায়গায় কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য আমাদের হোমওয়ার্ক করতে হবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যিক সুবিধা আরও ১২ বছর চালু রাখার কথা বলছে বালাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো। হয়ত এত সময় পাওয়া যাবে না, তবুও আমরা মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করব।