পাট পণ্যের অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কের মেয়াদ বাড়াতে নোটিশ দিয়েছে ভারত
মো. আখতারুজ্জামান : বাংলাদেশ থেকে পাটজাত পণ্য আমদানিতে ২০১৭ সালে যে চুক্তি হয় তার মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছর জানুয়ারি মাসে। এই মেয়াদ বাড়াতে ১৭টি প্রশ্ন সম্বলিত নোটিশ দিয়েছে ভারত। আগামী এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পাটকল মালিকদের এসব প্রশ্নের জবাব চিয়েছে ভারতীয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এই নোটিশে সব থেকে বেশি যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তাহলে ব্যবসায়ীরা লোকশান করে ভারতে পাট পণ্য রপ্তানি করতেছে না এমন প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
উৎপাদন মূল্যের তুলনায় কম মূল্যে বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানি হচ্ছে- এমন অভিযোগ তুলে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে ভারত। প্রতি টন পাটপণ্যে ১৯ থেকে ৩৫২ ডলার পর্যন্ত শুল্ক আরোপ রয়েছে এখন। তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অভিযোগ অসত্য বলে দাবি করে আসছে বাংলাদেশের মিলগুলো।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগের পণ্য রপ্তানি করলে যে লাভ হতো এখন সেটা হচ্ছে না। ভারতে আমাদের প্রতি যে অভিযোগ তুলে আসছে এটার একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া প্রয়োজন। আমরা ব্যবসায়ী চেষ্টা করবো লাভ করতে। লোকশানে তো আর পণ্য রপ্তানির চিন্তাও করা যায় না। এটার জন্য সরকার টু সরকার বসে আলোচনা করতে হবে। ২০১৭ সালে যখন ভারত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে তখন থেকেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলে আসছিলো যাতে করে এই শুল্ক কমানো হয়। এখন পর্যন্ত শুল্ক কমানো হয়নি।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ট্রেড রেমিডিস (ডিজিটিআর) থেকে গত সোমবার একটি নোটিশ পাওয়া গেছে। এতে পাটের সুতার ২৯ পণ্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতার মান নির্ধারণে কাউন্ট-ভিত্তিতে এই পণ্যগুলোকে চিহ্নিত করেছে ডিজিটিআর। পাটের বস্তা তৈরির সুতার ৮ কাউন্ট থেকে ১২ পর্যন্ত এক ধরনের ক্যাটাগরি। ১২ থেকে ১৬ পর্যন্ত আরেক ধরনের। এভাবে ২৮ কাউন্ট পর্যন্ত বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। একইভাবে অন্যান্য পাটপণ্য তৈরিতে ব্যবহূত সুতার আমদানির ক্ষেত্রেও কাউন্ট ভেদে পণ্য চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে প্রস্তুত পণ্য হিসেবে পাটের ব্যাগ, পাটের চট, পাটের কাপড় আগের মতোই একক পণ্য হিসেব সানসেট পর্যালোচনায় থাকছে।
সানসেট রিভিউর পদ্ধতির প্রশ্নে গত মাসে বাংলাদেশের মতামত চায় ডিজিটিআর। প্রডাক্ট কোড নম্বর পদ্ধতিতে পর্যালোচনার বিষয়ে ভারতের প্রস্তাব ছিল। এই পদ্ধতিতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের আপত্তি নেই বলে কয়েকজন উদ্যোক্তার পক্ষ থেকে জানানো হয়। এরপরই গত ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে এক মাস অর্থাৎ ২৭ অক্টোবরের মধ্যে ডিজিটিআর সব প্রশ্নের লিখিত জবাব দেওয়ার জন্য নোটিশ জারি করেছে।
গত জুনে সানসেট রিভিউ উদ্যোগ নেয় ডিজিটি। গত মাসে ১৭ বিষয়ে একটি প্রশ্নমালা তৈরি করা হয়েছে। ডিজিটিআরের নোটিশ বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন থেকে গত মাসেই পাটকলগুলোকে অবহিত করা হয়। পাটকলগুলোর কাছে ডিজিটিআরের দেওয়া প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়েছে। এতে দেখা যায়, ঐ প্রশ্নপত্রে পাটকলের যাবতীয় তথ্য চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভারত ছাড়াও আর কোন কোন দেশে কী পরিমাণ রপ্তানি হয়, উৎপাদন সক্ষমতা কত, শ্রমিকের সংখ্যা এমনকি পাটকলের নিট সম্পদের মূল্যও জানতে চাওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে ট্যারিফ কমিশনের সহকারী প্রধান আবদুল লতিফ বলেন, বাংলাদেশের পাটপণ্যে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপের মেয়াদ বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই সানসেট রিভিউ করছে ভারত। মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন না হলে নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত পাঁচ বছর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুল্ক আরোপ কার্যকর থাকে না। নতুন করে আর কোনো ধরনের পর্যালোচনার প্রয়োজন হতো না। তিনি জানান, আগেই বাংলাদেশকে প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছে ভারত। ট্যারিফ কমিশন পাটকলগুলোকে প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছে। পাটকলগুলোর কাছ থেকে জবাব পাওয়া গেলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে তা সরবরাহ করবেন তারা।
তিনি জানান, পিসিএন পদ্ধতিতে তথ্য যাচাইয়ে ভারতের পাঠানো তালিকার সবগুলোই বিভিন্ন ক্যাটাগরির পাটের সুতা। এই পদ্ধতিতে কেবল উল্লিখিত সুতার তথ্যই যাচাই করা হবে।
ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান এম সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল বলেন, আগে ভারতে কোনো ধরণের শুল্ক ছাড়াই পাটজাত পণ্য রপ্তানি করতে পারতাম। ২০১৭ সালে ভারত পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে। সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী জানুয়ারি মাসে। নতুন করে এই চুক্তি করার জন্য চিঠি পাঠিয়েছে ভারত। সেই চুক্তির আওতায় রয়েছে বিভিন্ন ধরণের ১৭ প্রশ্ন। এটা নতুন নয়। প্রথম যখন অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে সেই সময়ও এই প্রশ্নযুক্ত ফরম ছিলো। তিনি বলেন, এই নোটিশের মূলবক্তব্য হচ্ছে আমাদের ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, ভারতে পাটজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আমি কোনো ধরণের ডাম্পিং করছি না। অর্থাৎ লোকশনে কোনো পণ্য বিক্রি করে না।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি করে সর্বোচ্চ ১২৮ কোটি ডলার আয় করে বাংলাদেশ, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি ছিল। ওই বছর ভারতে ১০৯ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতের বাজারে ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ভারতে এক কোটি ৬৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে এক কোটি ২৩ লাখ ডলারের। এছাড়া প্লাস্টিক দ্রব্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২২ লাখ ৬০ হাজার ডলার।