৩২ ট্রিলিয়ন ডলার ট্যাক্স ফাঁকির গোপন তথ্য ফাঁস প্যান্ডোরা পেপারে
প্রিয়াংকা আচার্য্য ও লিহান লিমা : এবার কলিযুগে খুললো প্যান্ডোরা বাক্স। আর্থিক কেলেঙ্কারির বৃহত্তম তথ্য ফাঁস হলো রোববার রাতে। এতে ঘুম হারাম হলো বিশে^র নামীদামী সব ব্যাক্তিত্বের। যে আর্থিক নথিপত্র ফাঁস হয়েছে, তাতে দেখা গিয়েছে দেশের নজরদারি এড়াতে প্রথমসারির ব্যক্তিরা কীভাবে তাদের সম্পদ বিদেশি অ্যাকাউন্টগুলিতে সরিয়ে দিয়েছেন।
ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিটাম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি তথ্য প্রকাশ করে বলে সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়েছে।
বিবিসি, গার্ডিয়ান, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলির ৬০০ সাংবাদিক প্যান্ডোরা পেপার অনুসন্ধানে যুক্ত ছিলেন।
ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গিয়েছে, বিদেশে নানা অবৈধ লেনদেন শেষ করার সুযোগ থাকলে ক্ষমতাবানরা গোপন কোম্পানি ও ট্রাস্টে সম্পদ লগ্নি করে কিভাবে সুবিধা ভোগের পথ বেছে নিয়েছেন।
রোববার ‘দ্য প্যান্ডোরা পেপার্স’- এ বিশ্বের বর্তমান ও সাবেক ৩৫ জন নেতা, ৩৩৬ জন উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক এবং সরকারি কর্মকর্তা, ১ হাজার কোম্পানি এবং ব্যবসায়ী, বিলিওনার, তারকাদের নাম উঠে আসে। এদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, মানি লন্ডারিং এবং করফাঁকির অভিযোগ আনা হয়েছে।
দেখা যায়, জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আাবদুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ১০০ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ গড়েছেন। ২০০৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে করস্বর্গগুলোতে নিবন্ধিত সংস্থাগুলোর মাধ্যমে মালিবু, দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া, ওয়াশিংটন এবং লন্ডনে এসব সম্পদ কেনা হয়েছিলো।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ এবং তার পরিবার গোপনে ৫৪২ মিলিয়ন ডলারে ব্রিটেনে সম্পত্তি ক্রয় করেছেন।
চেক রিপাবলিকানের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেস বাবিস মালিকানা গোপন রেখে ফ্রান্সের দক্ষিণের ২২ মিলিয়ন ডলারের একটি উপকূল কিনতে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ সরিয়ে নিয়েছিলেন।
রুশ নারী শ্বেতালান ক্রিভোনেখিগ কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরে ২০০৩ সালের এপ্রিলে ক্যারিবিয়ান টর্টোলা দ্বীপে একটি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে মোনাকোর একটি অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হন। তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে কয়েক বছর যাবত গোপন সম্পর্কের মধ্যে ছিলেন বলে জানা গেছে। ফাইলে ভøাদিমির পুতিনের নাম না থাকলেও বলা হয় তিনি সহযোগীদের মাধ্যমে মোনাকোতে গোপন সম্পত্তি ক্রয় করেছেন।
সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার অফশোর কোম্পানি কেনার সময় লন্ডনের বহু মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পত্তি কর পরিশোধ এড়িয়ে গিয়েছেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কাছের মানুষ, মন্ত্রীসভা এবং তাদের পরিবার গোপনে অফশোর কোম্পানি এবং ট্রাস্ট্রের মালিক, সেখানে তাদের কোটি কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে। নথিতে পাকিস্তানের সামরিক নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পদও দেখানো হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং আর্থিক স্বচ্ছতার জন্য প্রচারণা চালানো কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা ও তার পরিবারের ৬ সদস্যের সঙ্গে ১৩টি অফশোর কোম্পানির সম্পৃক্ততা রয়েছে।
রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি কর ফাঁকি দিতে করস্বর্গে সম্পদ লুকানোর অভিযোগে নথিতে নাম এসেছে কলম্বিয়ান গায়িকা শাকিরা, জার্মান সুপার মডেল ক্লদিয়া শিফার এবং ভারতীয় ক্রিকেটার শচিন টেন্ডুলকারের নাম।
ভারতের শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানির ভাই অনিল আম্বানি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনের এক আদালতে তিনি দাবি করেন, তার সম্পত্তির পরিমাণ এখন ‘নেট জিরো’- অর্থাৎ শূন্য। অথচ তার নামও দেখা গেল প্যান্ডেরা পেপারে।
এর আগে আইসিআইজি ২০১৪ সালে লুক্সলিকস এবং ২০১৬ সালে পানামা পেপার প্রকাশ করে। যা আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং পাকিস্তানের নেতাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পথ সুগম করেছিলো। এরপর ২০১৭ সালে প্যারাডাইস পেপার এবং ২০২০ সালে প্রকাশ করা হয় ফিনসেন ফাইল।
পানামা পেপার্সে বিদেশে সম্পদ সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি ফাঁস হওয়ার পর বিদেশি সংস্থার মালিকরা নতুন নতুন পন্থা বেছে নিয়েছেন।
আর্থিক অপরাধের জন্য অভিযুক্ত হয়ে যারা তদন্তের আওতাধীন, তারা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস বা পানামার পাশাপাশি সামোয়া, বেলিজ বা কুক আইল্যান্ডের করফাঁকির স্বর্গরাজ্যগুলিতে বিদেশি নেটওয়ার্ক গড়েছেন।
এই অফসোর সিস্টেমের বিস্তারিত জানাতে গিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্যান্ডোরা পেপার্সে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে অফসোর মানি মেশিনের পর্দাফাঁস হয়েছে। এগুলি শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত দেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সর্বত্র সক্রিয়। সূত্র : বিবিসি, গার্ডিয়ান, ওয়াশিংটন পোস্ট, উইকিপিডিয়া।