নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল, ক্রেতার নাভিশ্বাস
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
করোনার সংক্রমণ কমে আসার লক্ষণ শুরু হতে না হতেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বাড়তে শুরু করেছে, বাজারে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মনে হচ্ছে যেন দেড় বছরের করোনাকালে যার যা ক্ষতি হয়েছিলো তা সুদে-আসলে উসুল করতে নেমে পড়েছেন ব্যসবাসায়ীরা। পণ্যের দামের কোনো বালাই নেই। নানা অজুহাতে সাধারণ বিক্রেতা পর্যায়েও পণ্যের দাম আজ যা হাঁকা হচ্ছে, কালও নতুন অজুহাত দেওয়া হচ্ছে। বরাবরই দাবি করা হচ্ছে যে, বাজারে সরবরাহ কম। তাই বিক্রেতার করার কিছু নেই। আড়তদারদের জিজ্ঞেস করা হলে কখনো শুনতে হয় সরবারাহে ঘাটতি নেই, খুচরা দোকানিরাও তাদের ইচ্ছামতো দাম হাঁকাচ্ছে। আবার কখনো কখনো বলা হচ্ছে আমদানিতে ঘাটতি আছে, বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে গেছে, তাই আমদানিকৃত পণ্যের দাম কিছুটা বাড়াছেই, তাদের করার কিছু নেই। দামের তারতম্য বাজারভেদে ঘটছে, এলাকাভেদেও ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে সারাদেশেই। নিত্যপয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর দামের পেছনে ক্রেতা সাধারণ দৌড়াচ্ছে, কিন্তু কোথাও প্রকৃত মূল্যে কেনাকাটা করতে পারছে না। টিভি চ্যানেলগুলো প্রায় প্রতিদিনই পণ্যের বাজারদাম যার যার সূত্রমতে জানাচ্ছে, কারো দামের সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুক্রবারের বাজারদর এমনিতেই থাকে তুঙ্গে, তার ওপর মিডিয়ায় যখন ভিন্ন ভিন্ন বাড়তি দামের কথা প্রচার করে তাতে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতারদেরই লাভ বেশি হয়। পণ্যের বিক্রেতারা টেলিভিশনে প্রচারিত দামের কথা শোনাতে ভুল করে না। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো কিছুর দাম বাড়ার সংবাদ টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রেতারা সেই পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক ‘মানে’ উন্নীত করতে মোটেও দেরি করেন না। আবার কোনো পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমার খবর প্রচারিত হলে বাজারে সেই পণ্যের দাম কমানোর কোনো লক্ষণ সহজে দেখা যায় না। তখন আড়তদার-বিক্রেতাদের একটাই কথা, বিদেশি পণ্য যখন আসবে তখন সেই মূল্যেই পাবেন।
এই হচ্ছে বাংলাদেশের বাজারে চলা পণ্যের দাম নিয়ে আড়তদার-বিক্রেতাদের ইচ্ছামতো দাম হাঁকানোর বাস্তবতা। পণ্যের বাজার স্থির রাখার কোনো ব্যবস্থাই কার্যকর নেই। মনিটরিংয়ের নামে মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট আসেন, কিছু জরিমানা করে বিদায় নেন। পরক্ষণেই লাভের অংক পুষিয়ে নিতেই বিক্রেতা দেরি করেন না। বাংলাদেশে কাঁচাবাজারের হালচাল এমনই, মুদি দোকানও তার বাইরে নয়। প্রশ্ন হচ্ছে কবে কীভাবে কাঁচাবাজার ও মুদি বাজারে পণ্যের মূল্য স্থির থাকবে, স্বাভাবিক হবে? মনে হয় এর কোনো উত্তর কেউ দিতে পারবেন না। যতোই বাজার তদারকি করার কথা বলা হোক না কেন তাতে ক্রেতাদের খ্বু একটা লাভ হয় না। আড়তদার, ফড়িয়া, বিক্রেতারা তাদের ইচ্ছামতোই বাজারদর ওঠানামা করান। ক্রেতারা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। এ থেকে বের হওয়ার সহজ উপায় আছে কিনা তা কেউ বলতে পারবেন না। [২] দেশে এবার স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ধান উৎপন্ন হয়েছিলো কিন্তু বাজারে কী বোঝা যায় যে বাংলাদেশে প্রচুর ধান-চাল কৃষকের ঘরে কিংবা বাজারে রয়েছে? চালের দামের ঊর্ধ্বগতি দেখে তো মনে হয় ধানের অভাব রয়েছে। কিন্তু সরকারের গুদামে এখন পনেরো লাখ টন মজুদ থাকার পরও চালের দাম সপ্তাহে কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা করে বাড়ানো হচ্ছে। চালের এই বাড়তি দাম কমছেই না। সরকার ভারত থেকে চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছেন, চাল আসছেও। তারপরও বাজারে মোটা ও চিকন চালের দাম স্থিতিশীল থাকছে না, সপ্তাহভেদে নতুন দামে বিক্রি করা হচ্ছে। অথচ প্রচুর ধান আড়তদাররা এখানে-সেখানে গুদামজাত করে রাখছে। উদ্দেশ্য চালের দাম কমার মতো সরবরাহ যেন সৃষ্টি না হয়। অল্প ক’দিন পরই নতুন ধান আসতে যাচ্ছে। তারপরও এখানে-সেখানে লুকিয়ে রাখা ধান চাতালে তোলা হচ্ছে না।
মজুদদারী ও সিন্ডিকেটধারী খেলায় এবারো চালের দাম ভোক্তাদের সামান্যতম স্বস্তি দেয়নি। এর প্রধান কারণ আড়তদার, চাতাল, চাল আমদানিকারক এবং ধানের ব্যবসায়ীদের কারসাজি। সেই কারসাজিতেই সরকারের নজরদারি ব্যবস্থা অকার্যকর, ক্রেতা সাধারণ অসহায়। [৩] বাজারে এখন শাকসবজির দাম নিয়ে ক্রেতারা নানা বিড়ম্বনায় আছেন। কাঁচা মরিচে এখন অনেকেই হাত দিতে ভয় পায়। গাজরের দাম শুনে ক্রেতার পালানোর পথ খোঁজা ছাড়া উপায় নেই। দুইশ, আড়াইশ কেজিতে গাজর কেনার কথা কে ভাববেন? তেলের দাম বাড়তি, চিনি-আটাও বাড়তি মূল্যেই বিক্রেতারা বিক্রির দাবি করছে। পেঁয়াজের দাম চার-পাঁচদিন আগেও ৪০ টাকার মধ্যেই ছিলো। একরাতেই পেঁয়াজ ৬০-৬৫ টাকাতে পৌঁছে গেলো, কে জানে আগামী সপ্তাহে এই মূল্য আরো যে কতো ওপরে ওঠবে। দু’বছর আগে তো পেঁয়াজের দাম আড়াইশ-তিনশ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। বলা হচ্ছে এবার ভারতে পেঁয়াজের ক্ষতি হয়েছে। পশ্চিম বাংলায় এক সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম দশ-বারো টাকা বেড়ে যাওয়ার খবর আসতে না আসতেই ঢাকার বাজারে কেজিপ্রতি ২০-২৫ টাকা বেড়ে গেলো। গণমাধ্যমেরই খবর হচ্ছে সীমান্তে পেঁয়াজের ট্রাক অপেক্ষায় আছে। প্রতিদিন কিছু কিছু ঢুকছেও। তারপরও পেঁয়াজের দাম হুট করে ৬০-৬৫ টাকায় ওঠে যাওয়ার খবর শুনে ভোক্তারা নিকট অতীতের দূর্মূল্যের পেঁয়াজের দামের কথা স্মরন করছেন । সামনে পুজোর উৎসব, পেঁয়াজের কদর একটু বাড়বেই সেই উপলক্ষেই কী কেজিপ্রতি ২০-২৫ টাকা বেড়ে গেলো? উৎসব শুরু হলে আর কতো বাড়বে? এবারও কি হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম ও ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানির খবর শুনতে হবে? যদি সেই দুঃসংবাদই আসে তাহলে আমাদের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো হবেই। তারা হয়তো এরই মধ্যে পেঁয়াজ লুকানোর কাজটি সেরে ফেলেছেনও! কেজিতে যদি ৭০-৮০ কিংবা ১০০ টাকা লাভ করা যায় তাহলে করোনার ক্ষতি খুব সহজেই পুষিয়ে নেওয়া যাবে। ইনকাম ট্যাক্সওয়ালারা এসব বাড়তি আয় দেখেন না। কেনা মূল্য ও বিক্রয় মূল্যের ব্যবধানে যদি ঠিকঠাকমতো কর বসানো যেতো তাহলে রাষ্ট্রের কোষাগারে কিছু অর্থ জমা হওয়ার সুযোগ হতো। কিন্তু হায়! আমাদের করকর্মকর্তারা ওই পথ মাড়ান না। তাদের যাওয়ার জায়গা পূর্ব র্নিধারিত। সেখানে নিজেদের পকেটেও কিছু ঢোকে অফিসেও ‘কর্মদক্ষতা’ দেখানো যায়। [৪] টিসিবিকে প্রতিবছর কিছু পণ্য সামগ্রী ট্রাকে করে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে দেখা যায়। সেই ন্যায্যমূল্যের পণ্য কিনতে মানুষের হুড়াহুড়ি ও দিনভর অপেক্ষা। তারপরও কারো ভাগ্যে জোটে কারো ভাগ্যে জোটে না। জানি সংস্থাটি এমন বিশৃঙ্খল বিপণন ব্যবস্থা কোথায় শিখেছে, তারা কী পারতো না প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগণের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী ন্যায্যমূল্যে ক্রয়ের একটি বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা তৈরি করতে। এলাকার কম আয়ের মানুষদের তালিকা প্রণয়ন এবং আইডি নম্বর ও ছবি সংযুক্ত করে দিলে ওই মানুষরাই নির্দিষ্ট দোকান থেকে ন্যায্যমূল্যে পণ্য ক্রয় করার সুযোগ পেতো। এখন যেভাবে রাস্তায় ট্রাকে টিসিবির পণ্য বিক্রি হচ্ছে তাদের দুর্নীতি,ফাঁকিঝুঁকি ‘জোর যার মুল্লুক তার নীতি কার্যকর হচ্ছে’ টিসিবির কর্মকর্তারা কী এখন কার্যক্রম দেখে না? দরিদ্র, প্রান্তিক এবং কম আয়ের মানুষদের জন্য টিসিবি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা চালু করতে পারতো। তাহলে কম আয়ের ভোক্তারা উপকৃত হতো। এখন কারা উপকৃত হচ্ছে সেই তালিকায় টিসিবির কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের নাম দেখা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে তারাই বেশি লাভবান হচ্ছেন। কাঁচাবাজার, মুদি দোকান নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রির বাজার নিয়ে কবে কর্তৃপক্ষ সজাগ হবে? সাধারণ মানুষের পকেট প্রতিদিনই খালি হচ্ছে, নাভিশ্বাস ওঠতে শুরু করেছে। অথচ বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের এমনটি হওয়ার কথা ছিলো না। সব পণ্যই আছে। কিন্তু সুশৃঙ্খল সরবরাহ ব্যবস্থা ও নেই বিপণনের ব্যবস্থা। দয়া করে কর্তৃপক্ষ সেদিকেই নজর দেবেন। লেখক : কলামিস্ট