
বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষবিন্দুতে চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি

সুব্রত বিশ^াস
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রায় ৭০ কোটি লোকের বসবাস, যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, লাতিন আমেরিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের চেয়েও বেশি। সম্মিলিতভাবে একে যদি একটি অর্থনৈতিক শক্তি ধরা হয়, তাহলে সেটি হবে বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পরেই বৃহত্তম অর্থনীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। পূর্বদিকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের মতো মার্কিন মিত্রদের জন্য চীনের অবস্থা বেশ খারাপ। সেই তুলনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনেকটাই শান্তশিষ্ট। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্যের এই লড়াই আরো জোরদার হবে মূলত দু’টি কারণে। প্রথমত: চীনের কাছে কৌশলগতভাবে এ অঞ্চলের গুরুত্ব ব্যাপক। এটি চীনাদের একেবারে দোরগোড়ায়, তার ওপর একদিকে তেল ও অন্য কাঁচামাল আমদানি, অন্যদিকে তৈরি পণ্য রপ্তানির বড় রুট। এই পথ দিয়ে চীনারা সহজেই ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হয়ে ওঠার মাধ্যমেই এই ‘অবরোধাতঙ্ক’ থেকে মুক্তি পেতে পারে চীন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক পরিণতি, চীনঘনিষ্ঠ হওয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনগণের ক্ষোভের বিষয়টি ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনাদের আধিপত্যের নিশ্চয়তা এখনো বহুদূর। এ অঞ্চলের দেশগুলো ধনী প্রতিবেশীর বিনিয়োগের লোভ না ছাড়লেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিয়মতান্ত্রিক শাসন তারাও প্রত্যাশা করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন অনেকটাই অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। ভিয়েতনামে প্রায়ই চীনবিরোধী বিক্ষোভ হয়। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ ইন্দোনেশিয়ায় অবৈধ চীনা অভিবাসন ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের সঙ্গে চীনের আচরণের বিরোধিতায় বিক্ষোভ হতে দেখা গেছে। এমনকি লাওসের মতো ছোট্ট দেশেও চীনবিরোধী সুর শোনা যায়। প্রতিবেশীদের ওপর চীনা সামরিক বাহিনী ছড়ি ঘোরানোতেও হতাশা বাড়ছে এ অঞ্চলে। দক্ষিণ চীন সাগর দখলের পাশাপাশি আশপাশের জলসীমায় মাছ ধরা বা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় নৌযানগুলোকে চীন নিয়মিত হয়রানি করা উত্তেজনার অন্যতম কারণ। এ নিয়ে চীনের সঙ্গে এখানকার প্রায় প্রতিটি দেশেরই ঝামেলা রয়েছে। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকারবিরোধীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে চীনাদের। লক্ষ্য করা যায়, চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই বন্ধনে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। চীনা বিনিয়োগ বিপুল হলেও তাতে ঘাটতি রয়েছে। দুর্নীতি বা পরিবেশগত ঝুঁকি অগ্রাহ্য করার অভিযোগ রয়েছে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। তাদের অনেকেই আবার স্থানীয়দের বাদ দিয়ে চীনা কর্মী নিয়োগ দিতে আগ্রহী, যাতে অর্থনৈতিক লাভ কমে যাচ্ছে। তাছাড়া, সামান্য মনোক্ষুণ্ন হলেই চীনের বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বদঅভ্যাস অন্য দেশগুলোর জন্য আতঙ্কের কারণ। চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার, এ অঞ্চলে মার্কিনিদের তুলনায় চীনারা অনেক বেশি বিনিয়োগ করে থাকে।
এখানকার অন্তত একটি দেশ- কম্বোডিয়া, ইতোমধ্যেই সব দিক থেকে চীনের আওতাধীন। অন্য দেশগুলোর মধ্যেও কেউ চীনকে ডিঙিয়ে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিতে যাবে না। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার অর্থনীতি বাড়ছে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ হারে, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামে এর পরিমাণ ছয় থেকে সাত শতাংশ। মিয়ানমার-কম্বোডিয়ার মতো এ অঞ্চলের দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনীতি বাড়ছে আরও দ্রুত। চীনবিমুখ বিনিয়োগকারীদের প্রধান ব্যবসায়িক কেন্দ্র হয়ে ওঠেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। চীন আজ সমৃদ্ধি আর উন্নয়নের মডেল। ১৮৭২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রই ছিলো বিশ্বসেরা অর্থনীতি। এতোকাল পরে এসে চীন অদ্যম শক্তিতে সেই শীর্ষস্থান দখল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেলে দিয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। আইএমএফের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সদ্য অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের বর্তমান অর্থনীতির আকার আর্থিক মূল্যে ১৭ দশমিক ৬১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে শীর্ষস্থানচ্যুত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আকার ১৭ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এদিকে ১৭ দশমিক ৬১ ট্রিলিয়ন ডলারেই চীনের অর্থনীতির উল্লম্ফন থেমে নেই। সংস্থার পূর্বাভাস হচ্ছে, ২০১৯ সাল নাগাদ চীনের অর্থনীতির আকার ২৬ দশমিক ৯৮ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে, যা হবে ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আকারের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হলেও ৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি থেকে একটা দীর্ঘ সময় ধরে প্রবৃদ্ধি বার্ষিক ১১ থেকে ১৩ বা তারও বেশি শতাংশ অব্যাহত রয়। চীন হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রপ্তানিকারক দেশ।
বিগত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা চলাকালে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ চীন ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের অনেক দেশকে বিশাল অর্থনীতির ধস থেকে উদ্ধার করেছে। ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীনে রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শ্রমশক্তি। চীনের রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাস্টিন লিন ২০১১ সালে বলেন, ২০১০ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত চীন ২০৩০ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে, যদি বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে। জেমস উলফেনসনের ২০১০ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের সর্বমোট মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের দুই-তৃতীয়াংশই হবে চীনের অধিবাসী। চীনের বর্তমান নেতৃত্ব অর্থনীতিকে আরো সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চীন তার বিশাল অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর মধ্য দিয়ে। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় চীন রপ্তানি বাজার সংকুচিত করে সুবিশাল এশিয়া মহাদেশের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বাণিজ্য প্রসারে প্রয়াস নিয়েছে। দেশটি তার মুদ্রা ইউয়ানকে আন্তর্জাতিকভাবে বিনিয়োগযোগ্য মুদ্রায় রূপান্তরিত করার ব্যবস্থা করেছে। ইউয়ান ইতিমধ্যে একটি আঞ্চলিক অর্থব্যবস্থার অংশ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের আদলে ব্রিকস চীন একটি এশীয় ব্যাংক করার উদ্যোগ নিয়েছে, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে এর সদস্যপদ লাভে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
চীন, রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট। চীন একে আরো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই জোটে অচিরেই ভারত যোগ দেবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে আসিয়ান হবে অন্যতম খুঁটিস্বরূপ। আসিয়ান ডলার ব্লক। চীন এটাকে ইউয়ান ব্লকে রূপান্তর করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ঐতিহ্যগতভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আসিয়ানের অর্থনৈতিক জোট বাঁধার প্রবণতা রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতসহ সার্কভুক্ত সব কটি দেশের সঙ্গে চীনের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। চীন দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী। চীন বিশ্বাস করে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে। বর্তমান বিশ্বে চারদিকে অস্থিরতা ও যুদ্ধের দামামা। দেশে দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংঘাত, সন্ত্রাসবাদ, জাতি-গোষ্ঠীর ঘৃণা, হানাহানি। আরো আছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও রোগব্যাধি। শান্তি এখনো সুদূরপরাহত। স্থিতিশীলতা বিশ্বজুড়ে নানাভাবে বিঘ্নিত। সমতা ও ন্যায়বিচারের অভাব প্রকট। বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর এক-পঞ্চমাংশ রয়েছে চীনে। দেশটি নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে এবং অবশ্যই ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সাধনে অনেক দীর্ঘ পথ এগিয়ে গেছে। চীন জনগণের দারিদ্র্য বিমোচন করেছে। তাদের জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং মানবজাতির উন্নয়ন ও প্রগতির ক্ষেত্রে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আজ চীন বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষে দাঁড়িয়ে। বোধগম্য কারণেই চীনের প্রতি বিশ্বের মনোযোগ বাড়ছে। বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, চীনের বর্তমান নেতৃত্ব চীনকে শান্তি, অগ্রগতি ও মর্যাদার আরো নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে এবং এশীয় অঞ্চলে ও সাধারণভাবে গোটা বিশ্বকে আরো শান্তিময়, সম্প্রীতিময় ও বাসযোগ্য করে গড়ে তোলায় প্রভূত অবদান রাখবে। লেখক : ব্যবসায়ী
