ডায়াবেটিস ও মানসিক স্বাস্থ্য দীর্ঘমেয়াদি হলেও ভালো থাকা যায় : অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম
শাহীন খন্দকার : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম আরো বলেছেন, ডায়াবেটিস সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি যে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণযোগ্য শারীরিক রোগ।
কিন্তু ডায়াবেটিস এর সাথে মানসিক রোগের যে একটা দ্বিমুখী সম্পর্ক রয়েছে তা হয়তো গোটা কয়েকজনেরই জানা। মানসিক স্বাস্থ্য সর্ম্পকে তিনি বলেন, মানসিক রোগে যারা ভুগছেন তাদের ডায়াবেটিস হলে তা নিয়ন্ত্রণ করাও বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
বিশেষত যাদের রক্তের গ¬ুকোজ বেশি, এবং ইনসুলিন ইনজেকশন নিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে, তাদের মানসিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা করতে পারে। অতি সংবেদনশীরতায় ভুগেন, তাদের রক্তে গ¬ুকোজ ও একটু আলাদা ভাবে ডায়াবেটিসের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে সাম্প্রতিককালের কিছু নুতন গবেষণা রির্পোটে।
ডা. শাহজাদা বলেন, ঔষধ দিয়ে মানসিক রোগের চিকিৎসা করার ফলে ডায়াবেটিস ও মানসিক সমস্যার নতুন ধরনের সংশি¬¬ষ্টতা জানা যাচ্ছে। মানসিক রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান হল বিশ শতকের গোড়ার দিকে ভাবা হতো যে, সিজোফ্রেনিয়তে রক্তের গ¬ুকোজ বাড়ে। ইদানীং কালের গবেষণায়ও অনেকটা এরূপ তথ্যই পাওয়া গেছে।
ডা. শাহজাদা সেলিম ডায়াবেটিস বিষন্নতা সর্ম্পকে বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে একজন ডায়াবেটিস রোগী অন্যদের চেয়ে ২ থেকে ৩ গুণ বেশি হারে বিষন্নতায় ভোগার ঝুঁকি রয়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এসব বিষন্ন রোগীদের মাত্র ২৫ থেকে ৫০শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়ে চিকিৎসা পাচ্ছেন।
কিন্ত, এ রোগটি শনাক্ত করা একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে কোন কঠিন কাজ নয়, চিকিৎসা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুবই ফলপ্রসূ হয় এবং ব্যয়বহুল নয়। আর চিকিৎসায় যদি অবহেলা করেন সেই ক্ষেত্রে রোগীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকবে।
বিষন্নতার লক্ষণসমূহ সর্ম্পকে আরো বলেন, আমেরিকান সাইক্রিয়াট্রিক এসোসিয়েশন বিষন্নতার নয়টি লক্ষণ উল্লেখ করে বলেছে কারও মধ্যে অন্তত পাঁচটি টানা দু সপ্তাহ বা ততোধিক সময় ধরে উপস্থিত থাকলে, সেটি বিষন্নতা হতে পারে। যেমন দিনের বেশীর ভাগ সময় মন খারাপ থাকা, কাজে আনন্দ পেতো কিন্ত কাজে আনন্দ ও আগ্রহ কমে যাওয়া, ঘুম অস্বাভাবিক কমে বা বেড়ে যাওয়া, খাবারে অরুচি,ওজন কমে যাওয়া, কাজে ও ধীরগতি, নিজেকে নেতিবাচক চিন্তা করা বা নিজেকে দায়ী মনে হওয়া সবকিছুতে অন্য দিকে,একজন লোক যদি দীর্ঘদিন বিষন্নতায় ভোগেন এবং চিকিৎসার বাইরে থাকেন তবে তার ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
গবেষকদের মতে, মোট ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর শতকরা সাত ভাগেরই পেছনে বিষন্নতা একটি প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ডায়াবেটিস ও অন্যান্য মানসিক সমস্যা সর্ম্পকে তিনি আরো বলেন,মানসিক রোগীদের একটা বড় অংশ ডায়াবেটিসে ভোগেন এবং শরীরে একই সাথে ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকির্পুণ বৈশিষ্ট্য উপস্থিত থাকে।
সিজোফ্রেনিয়র রোগী সর্ম্পকে ডা. শাহজাদা বলেন, একা একা কথা বলা, চুপচাপ থাকা, কারও কথার জবাব না দেওয়া, কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর না দেওয়া, কানে অলিক কথা শোনা, অসংলগ্ন কথা বলা, প্রতিদিনের কাজ সঠিকভাবে না করা, ভ্রান্ত বিশ্বাস,অহেতুক সন্দেহ প্রবণতা (ডিল্যুশন), অবাস্তব চিন্তাভাবনা, অসংলগ্ন কথাবার্তা ইত্যাদি সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ। সমবয়সীদের তুলনায় অনেক বেশি সময় বিছানায় থাকতে হয় তারা কম তাজা ফলমূল খেয়ে থাকেন। এজন্য তারা বেশি করে ডায়াবেটিস ও দৈহিক স্থুলতায় ভুগেন এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের ১৬ থেকে ২৫ শতাংশ ডায়াবেটিসে ভুগছে। বয়স বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হবার হার বাড়ে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মধ্যবয়সীদের দৈহিক স্থুলতা থাকলে ডিমনেশিয়া (স্মৃতি ভ্রষ্টতা) হার বাড়ে আর বেশি বয়সে ডিমনেশিয়া বাড়ে ডায়াবেটিসের কারণে। খাদ্যাভ্যাস বিষয়ক সমস্যাও হতে পারে ডায়াবেটিস রোগীদের। একজন লোকের ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এক সাথেই থাকতে পারে ডায়াবেটিস এবং মানসিক রোগ। অর্থাৎ, এদের কোনটাই অপরটার জন্য দায়ী নয়।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে, ডায়াবেটিস ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একটা হলে আরেকটা হতে পারে। অসচেতনতা, ভুল তথ্য, ডিভাইস নির্ভর বিনোদন, যান্ত্রিকতা ইত্যাদি রোগ দুটি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ফলে দিন দিন রোগ দুটি বেড়েই চলেছে। কয়েকটি উদাহরণ থেকে আমরা বিষয়টি সহজেই বুঝতে পারি।
করনীয় সর্ম্পকে তিনি বলেন,ডায়াবেটিস রোগীর নিজের এবং বিশেষভাবে তার পরিচর্যাকারীদের উচিৎ সবসময় খেয়াল রাখা– রোগীর মধ্যে বিষন্নতার কোনো লক্ষণ দেখা দিচ্ছে কিনা,আচার,আচরণে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে কিনা, মনের মধ্যে কোনো হতাশা বা অসহায়ত্ব জন্ম নিচ্ছে কিনা, খাদ্যাভ্যাসে কোনো পরিবর্তন আসছে কিনা প্রভৃতি।
তিনি বলেন, রোগীর নিকটজনদের মনে রাখতে হবে, এ ধরনের রোগীদের একটা সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, বিষন্নতার অনুভূতিকে অস্বীকার করা, নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা করা। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম এই প্রবাদ বাক্য মেনে রোগীকে সবসময় উৎফুল্ল রাখা, কর্মব্যস্ত রাখা, নিয়ম মেনে চলার জন্য উদ্বুদ্ধ করা এসবই হতে পারে ডায়াবেটিসের রোগীদের মধ্যে বিষন্নতা রোধ করার হাতিয়ার।