মুদি দোকানী থেকে কোটিপতি মানবপাচারকারী টুটুলসহ গ্রেপ্তার ৮
সুজন কৈরী : মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা সাইফুল ইসলাম ওরফে টুটুল ও তার সহযোগী তৈয়ব আলীসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গ্রেপ্তার চক্রের অন্যরা হলেন- শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন, মারুফ হাসান, জাহাঙ্গীর আলম, লালটু ইসলাম, আলামিন হোসাইন ও আব্দল্লাহ আল মামুন।
র্যাব জানায়, সম্প্রতি কয়েকজন নারী ভুক্তভোগীর অভিভাবক র্যাব-৪ এ মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার সংক্রান্ত অভিযোগ করেন। এরপর র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার রাতে র্যাব-৪ এর একটি দল রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোডের টুটুল ওভারসীজ, লিমন ওভারসীজ ও লয়াল ওভারসীজে অভিযান চালায়। এ সময় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ৪ জন ভিকটিম উদ্ধারসহ গ্রেপ্তার করা হয় মানবপাচার চক্রের ৮ সদস্যকে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ১০টি পাসপোর্ট, ৭টি ফাইল, ৪টি সীল, ১৭টি মোবাইল, ৫টি রেজিষ্টার, ৪টি ব্যাংকের চেক বই, ২টি কম্পিউটার, ৩টি লিফলেট এবং নগদ ১০ হাজার ৭০ টাকা উদ্ধার করা হয়।
বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, এইচএসসি পাস টুটুল মেহেরপুরের গাংনীর কামন্দী গ্রামে মুদি দোকানদার ছিলেন। মাঝে-মধ্যে ঢাকায় আসতেন। লোভে পড়ে মানবপাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। শুরুতে চক্রের দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানো শুরু করেন। পরে নিজেই রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় খুলে বসেন টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজ নামে তিন এজেন্সি। এর মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত অনেক নারী-পুরুষকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তৈয়ব টুটুলের প্রতারণার অন্যতম সহযোগী।
পড়াশোনা না জানা তৈয়ব চায়ের দোকানদার হলেও পরিচয় দিতেন স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে। টুটুলের প্ররোচনায় চক্রে জড়িয়ে প্রতারণামূলকভাবে বিদেশে মানবপাচারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার নামে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। অনেককে দিয়েছেন চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্রও।
মানবপাচার চক্রের অন্যতম সহযোগী গ্রেপ্তার শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন ও মারুফ হাসান ছিলেন বেতনভুক্ত কর্মচারী। গ্রেপ্তার চক্রের অন্যরা টার্গেট সংগ্রহ, প্রার্থীর পাসপোর্টের ব্যবস্থা, কথিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, টাকা সংগ্রহ, প্রাথমিক মেডিকেল সম্পন্ন করাসহ অন্যান্য কাজে সহায়তা করতেন।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, প্রতারক টুটুল ও তৈয়বের নির্দেশে চক্রের সদস্যরা টার্গেট সংগ্রহে দেশের বেকার ও অসচ্ছল যুবক-তরুণীদের সৌদি আরব, জর্ডান ও লেবাননসহ বিভিন্ন দেশের বাসা-বাড়িতে লোভনীয় বেতনে কাজ দেওয়ার নামে প্রলুব্ধ করতেন। এরপর বিদেশ যেতে আগ্রহীদের ঢাকায় মূলহোতা টুটুল ও তৈয়বের কাছে পাঠাতেন।
মোজাম্মেল হক বলেন, টুটুল ও তৈয়ব তাদের অফিসে এনে ভিকটিমদের বিদেশে বাসাবাড়িতে কাজের নামে পাঠানোর ভুয়া মানি রিসিট দেন। এজন্য প্রতিজনের কাছ থেকে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা নিত তারা। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও পাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য নিজেদের উচ্চশিক্ষিত বলে পরিচয় দিতেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাসাবাড়িতে কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভিকটিমদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আদায় করতেন চক্রের সদস্যরা।
তিনি বলেন, চক্রের কয়েকজন সদস্য অফিস স্টাফ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভিকটিমকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতেন। এতে ভিকটিমদের মনে আর কোনো সন্দেহ থাকত না। পাসপোর্ট অফিসের দালালের সঙ্গেও সখ্য ছিল চক্রের সদস্যদের। কথিত মেডিকেল টেস্ট শেষে নারী ভিকটিমদের বাসাবাড়িতে বিক্রি এবং পুরুষ ভিকটিমদের অমানবিক কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ, জর্ডান ও লেবাননে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করতেন তারা। ভিকটিমরা বিদেশে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারতেন না। যাদের বিদেশে পাঠানো সম্ভব হতো না তারা টাকা ফেরতের জন্য যোগাযোগ করলে ভয়ভীতি দেখানো হতো।
অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, চক্রের অন্যতম মূলহোতা গ্রেপ্তার তৈয়ব নিজেকে স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়ে শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের উচ্চ বেতনে লোভনীয় চাকরির কথা বলে যোগাযোগ করে। এরপর নিজ কার্যালয়ে নিয়ে যেতেন। বিভিন্ন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে চাকরিসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে ভুয়া চাকরির যোগদানপত্র দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন।
বৈধতা না থাকার পরও কীভাবে মানবপাচার করেছিলো চক্রটি- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মোজাম্মেল হক বলেন, তাদের তিন ওভারসিজ প্রতিষ্ঠানের বৈধতা না থাকায় বৈধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক মানুষকে পাচার করেছে। এছাড়া শতাধিক মানুষকে বিদেশে পাঠানো কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ২৫ জনের মতো ভুক্তভোগী র্যাবে যোগাযোগ করেছেন।
জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা হয়রানির অভিযোগ তুলে মানববন্ধন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যাব-৪ এর সিও বলেন, বৈধ কোনো জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে হয়রানি করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশ্য নয়। তবে বৈধতার আড়ালে কেউ যাতে মানবপাচার করতে না পারে সে জন্যই র্যাবের অভিযান। জনশক্তিখাতকে শুদ্ধ ও ভাবমূর্তি রক্ষাই অভিযানের মূললক্ষ্য। সম্পাদনা : ভিকটর রোজারিও