পোশাক খাতে নতুন চ্যালেঞ্জ সুতার দাম আরও বাড়তে পারে ডিসেম্বরে
মো. আখতারুজ্জামান : তৈরি পোশাক খাত করোনা মহামারী মোকাবেলা করে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নতুন শঙ্কার তৈরি হয়েছে সুতার দাম নিয়ে। কয়েক মাস থেকে বিশ্ববাজারে যেভাবে তুলার দাম বাড়ছে এটা অব্যহত থাকলে দেশের বাজারে ডিসেম্বরে সুতার দাম বাড়ার আভাস দিয়েছে সুতা ব্যবসায়ীরা।
বিশ্ববাজারে কয়েক মাস ধরেই তুলার দাম বাড়ছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর তুলার দামের সূচক ১০০ পয়েন্টে পৌঁছায়। তুলার এ দর বৃদ্ধি গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)-এর সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, গত আগস্ট থেকে আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত তুলার দাম বাড়তি থাকার পূর্বাভাস রয়েছে। এখন ক্রয়াদেশ দিয়ে নভেম্বরের মধ্যে সুতা সরবরাহ নিলে দাম বাড়বে না। তবে তুলার দামের সূচক ঊর্ধ্বমুখী থাকলে সুতার দাম ডিসেম্বরে বাড়বে। কয়েক দিন ধরে তুলার দর বৃদ্ধির প্রবণতা বিটিএমএর পক্ষ থেকে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ নেতাদের অবহিত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে মোহাম্মদ আলী।
তুলার দাম বাড়লে সুতার দাম বাড়ে। তুলার বর্তমান দরের বিবেচনায় দেশের স্পিনিং মিলে সুতার দাম অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ বাড়তে পারে। সুতার দাম বাড়লে তৈরি পোশাকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। এতে বস্ত্র এবং তৈরি পোশাক খাতে উদ্বেগ বাড়ছে।
২০১২ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার সূচক ছিল ৭২ দশমিক ৬৫ পয়েন্ট। পরের বছরের একই সময়ে ছিল ৮৭ দশমিক ৬৮ পয়েন্ট। ২০১৪ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সূচক কিছুটা কমে ৬২ দশমিক ৭১ পয়েন্ট ছিল। পরের বছরের একই সময়ে আরও কমে ৬১ দশমিক ২০ পয়েন্ট ছিল।
তুলার প্রধান ক্রেতা বস্ত্র খাত। আমদানি করা তুলায় সুতা তৈরি করে পোশাক উৎপাদন এবং রপ্তানিকারকদের কাছে প্রচ্ছন্ন রপ্তানি করে থাকেন বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা। বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, লাফিয়ে লাফিয়ে তুলার দর বৃদ্ধির এ প্রবণতা মাথায় রেখে বিদেশি ব্র্যান্ড এবং ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষির অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
এর আগে গত আগস্টে সুতার দর বৃদ্ধি নিয়ে বস্ত্র এবং পোশাক দুই খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়। সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে যায় বিজিএমইএ এবং বিটিএমএ। ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির অনুমতি চায় বিজিএমইএ। গত ২১ আগস্ট বিটিএমএ, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর মধ্যে সমঝোতা হয়। ত্রিপক্ষীয় ওই সমঝোতা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দরের সূচক সর্বোচ্চ ১০০ এবং সর্বনিম্ন ৮৫ পয়েন্টের মধ্যে থাকলে দেশে সুতার দর বাড়বে না। তবে পয়েন্ট ১০০-এর ঘর অতিক্রম করলে বাড়বে। আবার ৮৫ পয়েন্টের নিচে নেমে এলে সুতার দর কমবে।
বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এ মুহূর্তে আবারও সুতার দর বাড়লে পোশাক খাতে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। কারণ, ক্রেতাদের সঙ্গে দরদাম আগেই নির্ধারণ করেছেন তারা। ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার সিদ্ধান্ত বিটিএমএর সব মিল প্রতিপালন করেনি। কোনো কোনো মিল চুক্তির ব্যত্যয় করেছে। এর একটি তালিকা তারা বিটিএমএ সভাপতির কাছে পাঠিয়েছেন। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এদিকে বাড়তি ক্রয়াদেশের সুফল পেতে শুরু করেছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। গত সেপ্টেম্বরে ৩৪২ কোটি মার্কিন ডলার বা ২৯ হাজার ৭০ কোটি টাকার তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪১ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। এটিই দেশের ইতিহাসে কোনো এক মাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ পোশাক রপ্তানির রেকর্ড।
তুলার দর বৃদ্ধির প্রবণতা চলতে থাকলেও এখনই সুতার দর বাড়ানো হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিটিএমএ সভাপতি। তিনি বলেন, অন্তত আরও দুই সপ্তাহ তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চান। এ সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দর না কমলে দর বাড়াতে বাধ্য হবেন তারা। পোশাক খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিটিএমএ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই দর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দেশের উৎপাদিত তুলা দিয়ে গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তুলা একটি আন্তর্জাতিক মানের শিল্প ফসল, যা বিশ্বব্যাপী ‘সাদা সোনা’ হিসেবে পরিচিত। তুলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, ইতিহাস, সভ্যতা ও অর্থনীতি। এটি আমাদের দ্বিতীয় মৌলিক চাহিদা, বস্ত্রের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশ তুলা বোর্ডের তথ্যমতে, বিশ্বে প্রায় ৭৫ দেশে তুলা চাষ করা হয়। বিশ্বে তুলা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ৪০তম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে তিনটি শস্য মৌসুমের মধ্যে খরিফ-২তে মাত্র ০.৫২ শতাংশ জমিতে তুলা চাষ করা হয়। তুলা থেকে আঁশ ছাড়াও ভোজ্য তেল, খইল, জ্বালানি উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়। বিশ্বে শীর্ষ তুলা উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত ৫ হাজার ৭৭০ টন, যুক্তরাষ্ট্র ৩ হাজার ৯৯৯ টন, চীন ৩ হাজার ৫০০ টন, ব্রাজিল ২ হাজার ৭৮৭ টন এবং পাকিস্তান ১ হাজার ৬৫৫ টন। সম্পাদনা : ভিকটর রোজারিও