লোকসানে লবণ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কক্সবাজারের চাষিরা
আমান উল্লাহ : দেশের চাহিদা পূরণে লবণ উৎপাদনে কাজ করেন কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের মাত্র ৫৫ হাজার চাষী। কক্সবাজারের ৯ উপজেলার সাতটি ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীর কিছু অংশ নিয়ে প্রায় সাড়ে ৫৭ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ করে দেশের চাহিদা মেটান চাষীরা।
চাষীরা জানান, মাঠ পর্যায়ে তিন থেকে পাঁচ টাকা কেজি কিনে প্রক্রিয়াজাতের পর বাজারে প্যাকেটজাত লবণ ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হলেও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না চাষিরা। এর উপর একটি মুনাফালোভী গোষ্ঠী বিদেশ থেকে লবণ আমদানির চেষ্টা করে যাচ্ছে । ফলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না স্বয়ংসম্পন্ন দেশীয় লবণ শিল্প। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আর কেউ মাঠে লবণ উৎপাদন করবে না। এই শিল্পে জড়িত অনেকে পেশা ত্যাগ করে অন্য পেশায় সম্পৃক্ত হচ্ছে।
কক্সবাজারের টেকনাফের লবণ চাষি মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন,দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে তার পরিবার লবণ উৎপাদনে সম্পৃক্ত। গ্রীষ্মের ৫-৬ মাসে এক কানি জমিতে লবণ উৎপাদন হয় প্রায় ৯০০ মণ। এ পরিমাণ লবণ উৎপাদনে জমির ভাড়া, শ্রমিক, পলিথিন,পানি উত্তোলন, খাবারসহ অন্যান্য মিলে প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে বর্তমান বাজার দরে পাওয়া যাচ্ছে দুই লাখ ৫৭ হাজার টাকা।সেখান থেকে আরো প্রায় ৯০ হাজার টাকা চলে যায় পরিবহন ও ঘাট বা গুদি খরচে। সে হিসেবে উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে আয়-ব্যয় হিসাব করে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা ঘাটতি থাকে। গত ৫/৬ বছর ধরেই এ ঘাটতি টেনে আসছেন লবণ চাষিরা।
ঈদগাহ ইসলামপুর এলাকার লবণ ব্যবসায়ী আব্দুল আমিন বলেন, এই এলাকার অধিকাংশ পরিবার লবণ উৎপাদন, পরিবহন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। লবণ চাষে ক্ষতি হলেও বর্ষায় মৎস্য চাষে যুক্ত হয়ে কোনো মতে সংসার চালায়। ফলে, ঘাটতি মেটানোর আশায় পরের বছর আবার লবণ চাষে নামেন চাষীরা। এভাবে বেঁচে আছে দেশের স্বয়ং সম্পন্ন লবণ শিল্পে সম্পৃক্তরা চাষীরা।
বাংলাদেশ লবণচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, মাঠ থেকে লবণ কেনায় জড়িত ব্যবসায়ীরা একীভূত হয়ে লবণের দাম নির্ধারণ করে। সরকারি নির্দেশনায় উৎপাদিত লবণ বিক্রি করতে না পেরে লোকসানে পতিত হন প্রান্তিক চাষি বা লবণ উৎপাদকরা।
এছাড়াও দেশে উৎপাদিত লবণ চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকার পরও একটি মহল বিদেশ থেকে লবণ আমদানির চেষ্ঠা করছে। এতে মাঠ পর্যায়ে পড়ে থাকা লবণ নিয়ে বিপাকে রয়েছেন প্রান্তিক চাষিরা।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) কক্সবাজার জেলা ম্যানেজার (ডিএম) জাফর ইকবাল জানান, দেশে ২০২১ সালে লবণের চাহিদা নির্ধারণ হয় ২২ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন। ২০২১ মৌসুমে লবণ উৎপাদন হয়েছে ১৬ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন। তবে ২০২০ সালে তিন লাখ ৪৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উদ্বৃত্ত ছিল। সে হিসেবে ২০২১ সালের লবণের মজুদ ১৯ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন।
কাগজে কলমে দুই লাখ মেট্রিক টন লবণ ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু নিয়মিত ব্যবহারে পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে সাড়ে চার লাখ, মিল-কারখানায় দেড় লাখ এবং বিভিন্ন খুচরা মজুতদারের কাছে জমা অন্তত এক লাখ মেট্রিক টন মিলে প্রায় সাত লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুত আছে। মাসে পৌনে দুই লাখ মেট্রিক টন চাহিদা মতে ডিসেম্বর পর্যন্ত লবণ দরকার হবে সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন। নভেম্বরে শুরু হবে নতুন লবণ উৎপাদন মৌসুম। তাই দেশে লবণের কার্যত সংকট নেই। আর সোডিয়াম সালফেক্ট বা অন্য যেকোনো লবণ আমদানিতে সরকার আগের তুলনায় তিনগুণ কর বাড়িয়েছে। এখন আগের মতো এসব লবণ আনার প্রচেষ্টা সফল হবে না।