মাংস বাণিজ্যে এশিয়ায় বছরে ৩ কোটি কুকুর হত্যা বাংলাদেশ থেকে ভারতে কুকুর পাচার হচ্ছে
অর্থনীতি ডেস্ক : দেশের সীমান্তবর্তী জেলা কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি থেকে কুকুর পাচার করে ভারতের মিজোরাম ও নাগাল্যান্ড রাজ্যের জীবন্ত পশু কেনা-বেচার বাজারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আইনে নিষেধ থাকলেও দেশের সীমান্তবর্তী জেলা রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অবাধেই কুকুর শিকার নিয়ে যাচ্ছে ভারতের মিজো ও কুকি উপজাতির লোকজন। পাচার হওয়া এসব কুকুর বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি ৬ থেকে ৭ হাজার টাকায়।
গত ২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার ২১ আনসার ব্যাটেলিয়ান জামে মসজিদ এলাকা থেকে কুকুর শিকারের কিছু ছবি-ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, দুই উপজাতি যুবক লাঠি ও দড়ি দিয়ে বানানো বিশেষ ফাঁদে আটকে বেশ কয়েকটি কুকুরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কুকুরটিকে ধরে ফেলার পর সরু তার দিয়ে কুকুরগুলোর মুখ বেঁধে দেয়া হয়। এ ছাড়া কুকুরগুলো যাতে পালিয়ে যেতে না পারে প্রতিটি কুকুরের গলায় আটকে দেয়া হয় শুকনো বাঁশ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও দীঘিনালা উপজেলার বাসিন্দা অভি বড়ুয়া বলেন, ভারতের মিজোরাম ও নাগাল্যান্ড রাজ্যের উপজাতিরা কুকুরের মাংস খায়। আর এই দুই রাজ্যের কুকুরের চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাচার হয় বাংলাদেশ থেকে।
কুকুরের এ চাহিদা মেটাতে মিজোরাম থেকে আসা কুকুর শিকারিরা পাহাড়ের বিভিন্ন হাট-বাজারে ঘুরে ঘুরে কুকুর ধরে। কিছু দিন পরপরই এই শিকারীরা কুকুর ধরতে আসে। এলাকায় এদের সবাই ‘মিজো’ নামে চেনে।
অত্যন্ত অমানবিকভাবে তারা কুকুর ধরলেও স্থানীয়রা কোনো বাঁধা দেয় না,- বলেন অভি বড়ুয়া।
প্রাণীকল্যাণ আইন ২০১৯ অনুযায়ী, মালিকবিহীন কুকুর হত্যা বা অপসারণ করা আইনত দ-নীয় অপরাধ। এ অপরাধের জন্য ৬ মাসের জেল এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
অভি বড়ুয়া জানান, প্রতি মাসেই খাগড়াছড়ির দীঘিনালার জামতলী বাজার, বোয়ালখালি বাজার, বাবুছড়া ও থানা বাজার থেকে কুকুর পাচার হয় ভারতে। এসব কুকুর ভারতের মিজোরামে ছাগল বা মুরগির মতোই বিক্রি হচ্ছে।
রাঙ্গামাটি পৌর এলাকার বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বলেন, বিভিন্ন সময় শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে লঞ্চে করে নদী পথে বেওয়ারিশ, এমনকি মালিকাধীন কুকুরও শিকারিরা ধরে নিয়ে যায়। তিনি জানান, গত ২৮ সেপ্টেম্বরও শহরের ফিসারিঘাটে কয়েকজন লোককে একটি বড় লঞ্চে কুকুর ভর্তি করে নিয়ে যেতে দেখেছেন।
পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য নেচারের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন রিয়াদ বলেন, ভারত-বাংলাদেশের সীমানা রেখার দুই পাশেই মিজো ও পাংখোয়া উপজাতির বসবাস; এরাই কুকুর খায়।
উপজাতিদের অনেকেই আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন, প্রতিবছর শীত মৌসূমে মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডে একটি উৎসব হয়। এই উৎসবে খুব অমানবিক ভাবে কুকুর হত্যা করে সে মাংস পুড়িয়ে খাওয়ার রীতির প্রচলন আছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে ট্রাকে করে এবং রাঙ্গামাটি শহর থেকে ইঞ্জিন চালিত বোটে করে এসব কুকুর প্রথমে রাঙ্গামাটির মাইনী বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মাইনী থেকে কাপ্তাই হৃদ হয়ে ঠেগামুখ সীমান্ত দিয়ে এসব কুকুর চলে যায় মিজোরামে। এমনই এক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আন্ডারওয়াটার ফটো সাংবাদিক শরিফ সারওয়ার।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, একটি গবেষণার কাজে প্রায় দুই মাস রাঙ্গামাটিতে ছিলাম।
সেসময় কাপ্তাই হৃদের বরকল এলাকায় আমরা একটি বোট দেখতে পাই, ঐ বোটে প্রায় ২০-৩০টি কুকুর ছিলো। খুব নির্মমভাবে পা-মুখ বেঁধে এসব কুকুরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো।
আমি যখন সেই বোটের লোকজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা জানিয়েছিলো রাঙ্গামাটি শহর থেকে কুকুর গুলো মিজোরামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নদী পথে তারা প্রথমে রাঙ্গামাটির ঠেগামুখ সীমান্তে যাবে, সেখান থেকে মিজোরাম, বলেন শরিফ সারওয়ার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙ্গামাটি জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. বরুণ কুমার দত্ত বলেন, শহর থেকে কুকুর ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের জানা নেই।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. মো. নুরুল আফসার বলেন, এটা যদি কেউ করে থাকে তাহলে তা অমানবিক কাজ। তবে বিষয়টি দেখার দায়িত্ব দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
তবে সীমান্ত দিয়ে ভারতে কুকুর পাচারের কোনো তথ্য বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) কাছ নেই বলে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সাহীদুর রহমান ওসমানী।
বিজিবি দক্ষিণ-পূর্ব রিজিয়নের কর্মকর্তা লে. কর্নেল আসাদ বলেন, টাকার জন্য সীমান্ত এলাকার মানুষরা অনেক কিছুই করে। আমাদের ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর অনেকেও কুকুর খায়। আপনাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই করে, এ কাজ কারা করছে, কেনো করছে তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেব।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) অধ্যাপক মোহাম্মদ রাশেদুল আলম বলেন, দেশের প্রাণী কল্যাণ গ্রুপগুলো এ বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার।
পরিবেশবিদ মোয়াজ্জেম হোসেন রিয়াদ বলেন, দেশের ভেতরে প্রকাশ্যে কুকুর নিধন হলেও এসব বন্ধে দেশের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কখনো কোনো পদক্ষেপ কখনো নেওয়া হয়নি। পশু সংরক্ষণ ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও তাদের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পায়নি।
বন্যপ্রাণী বিষয়ক সাংবাদিক ও সংরক্ষণকর্মী আমিনুল ইসলাম মিঠু বলেন, কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যে উদ্যোগগুলো এ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে সেগুলোর সবই রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক। কিন্তু সারাদেশে কুকুরের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কুকুরের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী বৃহৎকারে বন্ধ্যাকরণ কার্যক্রম নিতে হবে।
ভারতের পশু অধিকার বিষয়ক সংগঠন গুলোর দাবির মুখে, ২০২০ সালে মিজোরাম রাজ্য সরকার কুকুর জবাই, মাংস আমদানি, বাণিজ্য ও বেচাকেনা নিষিদ্ধ করে।
হিউম্যান সোসাইটি ইন্টারন্যাশনালের (এইচএসআই) তথ্যমতে, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম এবং উত্তর -পূর্ব ভারতের কিছু অংশে কুকুরের মাংসের বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় এশিয়া জুড়ে বছরে প্রায় ৩ কোটি কুকুর মারা যায়। শুধু মাত্র নাগাল্যান্ড রাজ্যে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ৩০ হাজার কুকুর পাচার করা হয়। সূত্র : টিবিএস বাংলা অনলাইন