সোয়ারীঘাটে জুতার কারখানায় আগুন ঘুমন্ত ৫ শ্রমিকের মৃত্যু
সুজন কৈরী : রাজধানীর সোয়ারীঘাটের কামালবাগে রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামক একটি জুতার কারখানায় অগ্নিকা- ঘটেছে। এতে দগ্ধ ও ধোয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আহত আরও দুজনকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড) পাঠানো হয়েছে। হতাহতদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, কারখানায় প্রচুর পরিমাণ সিলিউশন ও রাবার জাতীয় কাঁচামাল ছিলো। এছাড়াও ডিওপি তেল মজুদ ছিল, যা দাহ্য পদার্থ।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে ঐ কারখানায় আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা কাজ করে রাত ৩টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
ফায়ার সার্ভিসের কেন্ট্রাল রুম থেকে জানানো হয়, সংবাদ পেয়ে আটটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। রাত তিনটায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। অগ্নিকা-ের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তদন্ত সাপেক্ষে জানা যাবে। কারখানার ২য় তলায় ঘুমানো অবস্থায় ৫ জন অগ্নিদগ্ধ ও ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ অবস্থায় মারা গেছেন। এছাড়া দুজন লাফিয়ে পড়ে আহত হন। মৃত শ্রমিকদের উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর আহতদের মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
কারখানার নিরাপত্তারক্ষী ফারুক জানান, রাত আনুমানিক ১টা ১০ মিনিটের দিকে কাঁচা বাজারসহ জুতার কারখানায় আগুন লাগে। পরে ফায়ার সার্ভিসকে জানানো হয়। সংবাদ পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
তিনি আরও জানান, কারখানায় ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক কাজ করেন। আগুন লাগার সময় তারা ঘুমিয়ে ছিলেন। আগুন লাগলে চিৎকার শুনে অনেকে বের হতে পারলেও পাঁচজন পারেননি। তারা দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
স্থানীয়রা জানান, রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানায় বার্মিজ ও স্পঞ্জের জুতা তৈরি হতো। কারখানাটিতে জুতা তৈরিতে ব্যবহৃত রাবার, প্লাস্টিক ও কেমিক্যাল ভর্তি অনেক ড্রাম ছিলো। এসব দাহ্য পদার্থের কারণেই আগুন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।
কামালবাগ আবাসিক থেকে প্রায় ১৫০ গজ দূরে জুতার কারখানা। কারখানায় প্রবেশের সময় নিচতলায় কেমিক্যাল ভর্তি একাধিক ড্রাম চোখে পড়ে। আগুনে পুড়ে যাওয়া জুতা তৈরিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও রাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। এছাড়া আগুনে কারখানা সংলগ্ন মদিনা নামে একটি কাঁচাবাজারও আগুনে পুড়ে গেছে।
কারখানার একতলার ওপর পাটাতন দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে শ্রমিকদের থাকার জন্য খোপ তৈরি করা হয়েছিলো। সেখান থেকেই মৃত পাঁচ শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুড়ে যাওয়া জুতার কারখানার আশপাশে একাধিক কেমিক্যালের দোকান দেখা গেছে।
পুড়ে যাওয়া জুতার কারখানা সংলগ্ন একটি কারখানায় ঘটনার সময় নাইট ডিউটিতে কাজ করা আমির হোসেন বলেন, রাত ১টার পর পরই বিকট শব্দ শুনতে পাই। পরে আগুন আগুন বলে চিৎকার শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখতে পাই, জুতার কারখানা জ্বলছে। আগুনের তাপ অনেক বেশি হওয়ায় আশপাশে যাওয়া যাচ্ছিলো না।
তিনি বলেন, আমি নিজেও জুতার কারখানায় কাজ করি। বার্মিজ জুতা বানাতে ডিওপি তেল ব্যবহার করা হয়। এখানেও এই কেমিক্যাল ছিলো। এছাড়া জুতা বানাতে ব্যবহার করা হয় প্লাস্টিক ও রাবার। এসব জিনিস থাকায় আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিলো।
জুতার কারখানা সংলগ্ন মদিনা ট্রান্সপোর্ট মার্কেটের সুভার ভাইজার মো. রফিক বলেন, ১০-১২ বছর আগে রফিক হাজী জমি লিজ নিয়ে কারখানাটি করেন। রফিক হাজীর বাসা চকবাজারের রহমতগঞ্জের হাজী রোডে। রাত ১টার দিকে মার্কেটের নাইট গার্ড ফোন দিয়ে আগুন লাগার কথা জানান। সকালে এসে দেখি কারখানাটি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। আগুনে পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যুর কথাও জানতে পারি। তিনি বলেন, বার্মিজ জুতা বানাতে প্রচুর পরিমাণ কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। তবে এসব কেমিক্যালে আগুন লাগে কি-না তা আমি জানি না।
এদিকে শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইড) ক্রাইম সিন ইউনিট।
ইউনিট প্রধান পরিদর্শক মো. সাইফুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, ঘটনাস্থল থেকে বেশকিছু আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। কেমিক্যাল সদৃশ্য কিছু আলামত সংগ্রহ করেছি। এগুলো সিআইডির রাসায়নিক ল্যাবে পরীক্ষা করলে বলা যাবে আসলে এগুলো দাহ্য পদার্থ ছিল কি-না।
তিনি বলেন, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া পাঁচ মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কিন্তু আগুনে মারাত্মকভাবে পুড়ে যাওয়ায় সম্ভব হয়নি। ডিএনএ পরীক্ষার ছাড়া শনাক্ত করা যাবে না।
চকবাজার থানার ওসি মো. আবদুল কাইউম বলেন, আগুনে পাঁচ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আর কেউ হতাহত হননি। নিহতদের নাম পরিচয় এখনো যানা যায়নি। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) হাফিজুর রহমান বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও এর সূত্রপাতের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে সূত্রপাত হযেছে। তদন্ত সাপেক্ষে আগুনের প্রকৃত কারণ জানা যাবে। ঘটনা তদন্তে ৪ থেকে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হবে।
তিনি বলেন, কারখানায় কোনো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিলো না। প্রচুর পরিমাণ সলিউশন ছিলো। এগুলো উচ্চ দাহ্য পদার্থ। এছাড়া রাবার জাতীয় কাঁচামাল পাওয়া গেছে। রাবার পুড়ে গিয়ে এক ধরনের তরল বের হয়, যা পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ। এছাড়াও দাহ্য পদার্থ ডিওপি তেলও মজুদ ছিলো। এজন্য আগুনে তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।