অপুষ্টি দূর করতে গাঁজায়িত খাদ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে
মতিনুজ্জামান মিটু : বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পাশাপাশি দেশের সার্বিক পুষ্টি পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটলেও বিরাট জনগোষ্ঠী এখনও অপুষ্টিজনিত সমস্যার শিকার। এ সমস্যা দূরীকরণে গাঁজায়িত খাদ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে। কেননা গাঁজায়িত খাবার বাজার থেকে না কিনে ঘরে বসে সহজেই তৈরি করা যায়।
গাঁজন প্রক্রিয়া খুবই সহজ, বেশি সময় ধরে রান্নারও দরকার হয় না। গাঁজন প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরিতে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্য টাটকা ও অর্গানিক দ্রব্যাদি পছন্দের শীর্ষে রাখা দরকার। যে কোন প্রকার সবজি-ফল গাঁজায়িত করার জন্য ব্যবহার করা যায়। তবে কিছু কিছু সবজি-ফল গাঁজায়িত করার জন্য উত্তম, যেমন- বাঁধাকপি, শালগম, মূলা, বিটরুট, আপেল ইত্যাদি। তাছাড়া গাঁজন প্রক্রিয়ায় প্রিবায়োটিক সমৃদ্ধ খাদ্যসামগ্রী; যেমন- পেঁয়াজ, এসপ্যারাগাস, লিকস (বাচ্চা পেয়াজ কুশিসহ) এবং আর্টিচকস (অনেকটা শরীফা বা আতাফলের মতো) এগুলো যোগ করা যায়। কেননা এসব উচ্চ আঁশ সমৃদ্ধ খাদ্য অন্ত্রে ভাল ব্যাকটেরিয়া তৈরিতে অত্যন্ত সহায়ক।
গাঁজায়িত খাবারের উল্লেখযোগ্য সুবিধা তুলে ধরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল সদস্য পরিচালক ড. মো. মনিরুল ইসলাম জানান, গাঁজায়িত খাবার গ্রহণে স্বাস্থ্যগত নানাবিধ উপকার পাওয়া যায়। খাবারে বিরাজমান চিনি ও স্টার্চ বিভিন্ন এনজাইমেটিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে যায়; ফলে হজমে সহজ হয়। গাঁজন পদ্ধতিতে দুধের ল্যাকটোজ ভেঙ্গে সাধারণ চিনি-গ্লুকোজ-গ্যালাকটোজ-এ পরিণত হয়। যারা ল্যাকটোজ সংবেদনশীল তাদের জন্য দধি ও পনির সহজেই হজমযোগ্য। তাছাড়া যাদের তাজা বা টাটকা ফল-সবজি হজমে সমস্যা হয়; তাদের জন্য ফার্মেন্টেড ফল-সবজি গ্রহণ উত্তম। কারণ অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া খাবারকে প্রি-ডাইজেষ্ট করে, ফলে হজমে সহজ হয়। সাধারণ খাবারে উপস্থিত বিভিন্ন মিনারেলস বা ভিটামিন আবদ্ধ অবস্থায় থাকে, ফলে শরীরে তা ভালভাবে শোষণ হয়না। গাজায়িত খাবারে এসব পুষ্টিকণাগুলো বন্ধনহীন হয়ে পড়ায় সহজেই তা মানবদেহে শোষিত হয়। উপরন্তু, অন্ত্রে বাসকরা বা কলোনিক ব্যাকটেরিয়া নানা ধরনের বি-ভিটামিনস ও ফলিক এসিড উৎপন্ন করে ও ভিটামিনগুলোকে সংশ্লেষণ করে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও জানান, ফার্মেন্টেড খাবার ভাল ব্যাকটেরিয়ায় ভরপুর। বিশেষজ্ঞদের মতে, আধা কাপ বা এক গাল গাঁজায়িত খাবারে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে; যা দেহকোষের ১০ গুণ। তাই বেশি আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া অন্ত্রের জন্য ভাল।
বেশিরভাগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (প্রায় ৮০ ভাগ) অন্ত্রের আশপাশ ঘিরে অবস্থান করে। গাঁজায়িত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে সহজেই অন্ত্রের ঝিল্লি, যা প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষা করে; তার প্রতিরোধ কার্যকরিতার আরও উন্নয়ন ঘটানো যায়। অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার অভাব হলে তা রোগ-সৃষ্টিকারী জীবাণু সৃষ্টিতে উৎসাহ দেয়। ফলে অন্ত্রের দেয়াল ফুলে যায়। এন্টিবায়োটিক গ্রহণের পরপর গাঁজায়িত খাবার গ্রহণ খুবই সাহায্যকারী।
অধিকতর ক্ষুধা নিবারণ করে অর্থাৎ প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকায় গাঁজায়িত খাবার যোগ করলে খাবারের চিনির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমায়।
খাবারের স্বাদ বাড়ায়। গাঁজায়িত খাবার বাড়িতেই বানানো যায়। ইহা স্বাদ ও গন্ধ বাড়ায়। খাদ্যে প্রাকৃতিকভাবে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া খাদ্যের চিনি ও স্টার্চকে ভেঙে ল্যাকটিক এসিড উৎপন্ন করে। যা খারাপ ব্যাকটেরিয়াকে জন্মাতে বাধা দেয়, খাবার স্বাস্থ্যকরভাবে সংরক্ষিত হয় ও পচেনা। এ প্রক্রিয়ায় খাবার শুধু সংরক্ষণ দীর্ঘায়িত করে না, খাবারের মানও আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর করে।
পুষ্টিবিদ ড. মো. মনিরুল ইসলাম জানান, ফার্মেন্টেড বা গাঁজায়িত খাদ্য হচ্ছে প্রাণিজ বা উদ্ভিজ উৎসের সে সব খাদ্য, যা ল্যাক্টোফার্মেটেশন পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়। যেখানে প্রাকৃতিকভাবে বিরাজমান ব্যাকটেরিয়া, চিনি ও শর্করা জাতীয় খাদ্যের উপর নির্ভর করে এবং ল্যাকটিক এসিড উৎপাদন করে। ফার্মেটেশনবা গাঁজায়ন হচ্ছে পরিবেশে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি যা অনুজীব, ইস্ট বা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে শর্করাকে ভেঙে এলকোহল বা জৈব এসিডে পরিণত করে।
সনাতন পদ্ধতিতে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে হতেই খাদ্য দ্রব্যের স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ পরিবর্তনজনিত ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন প্রক্রিয়া বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রচলিত হয়ে আসছে; যেমন মাংস হতে কিউরড সসেজ, দুধ হতে নীল পনির এবং বাঁধাকপি হতে কিমচি ইত্যাদি অন্যতম। পরিবর্তনশীল বিজ্ঞানের যুগে এসব খাবারে বাইর থেকে প্রোবায়োটিক যোগ করা হয়, ফলে বর্তমানে এসব গাঁজায়িত খাবার আরও অধিকতর পুষ্টিগুণ ও এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ।
গাঁজায়িত খাদ্য যেমন- মিসো, কিমচি, কেফির, কমবুচা, টেম্পাহ্, দধি, গাঁজনকরা মাছ, পান্তাভাত, সিদল শুঁটকি, ইডলি ইত্যাদিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও প্রচুর পরিমাণে রোগ প্রতিরোধকারী ও উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও অধিকতর অণুপুষ্টি পাওয়া যায়। তাছাড়া অনেক টাটকা বা তাজা খাবারে বিরাজমান অণুপুষ্টিগুলো আবদ্ধ অবস্থায় থাকে, যা দেহ শোষণ করতে পারেনা। কিন্তু গ্াজন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত খাবারগুলো এসব অণুপুষ্টি মুক্ত করে দেয়, ফলে মানুষের শরীরে তা সহজে শোষণ হয়। তাছাড়া গাঁজনকরা খাবারে এন্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রদাহরোধী বৈশিষ্ট্য থাকে। গাঁজন প্রক্রিয়া শুধু খাবার সংরক্ষণ করে না, উপকারী ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি, বি-ভিটামিনস, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড এবং বিভিন্ন প্রোবায়োটিকস উৎপন্ন করে। তাছাড়া খাদ্যের পুষ্টিমান উন্নয়ন ঘটায় ও খাদ্য হজমে সাহায্যে করে এবং এসব প্রোবায়োটিক অন্ত্রে প্রাকৃতিকভাবে উপস্থিত উপকারী ও রোগসৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার সমতার উন্নয়ন ঘটায়।
উল্লেখ্য, মানুষের সুস্থভাবে বাঁচার জন্য অন্ত্রের সুস্থতা জরুরী। বিজ্ঞানীদের ভাষায় অন্ত্র হলো মানুষের অদ্বিতীয় মস্তিষ্ক; তাই অন্ত্রের সুস্থতার জন্য অন্ত্রে উপস্থিত ভাল ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্যতা অত্যন্ত দরকার। আর এসব খারাপ ও ভাল ব্যাক্টেরিয়া ভারসাম্যতা রক্ষার্থে গাঁজায়িত খাবার বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
কালের আবর্তে আধুনিক জীবনধারায় অভ্যস্থ মানুষ স্বাস্থ্যকর এসব গাঁজায়িত খাবার প্রায় ভুলতে বসেছে। আধুনিক যুগে প্রযুক্তির উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও পরিবহণ সুবিধা বেড়ে যাওয়ায় বছর জুড়েই বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি পাওয়া যায় এবং ক্যানিং ও ফ্রিজিং করা হয়। এতে ভিটামিন ক্ষয় বা অপচয় কম হয়। তবে পরিপাক অন্ত্রের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এসব খাবার থেকে গাঁজায়িত খাবারের চেয়ে কম উপকার পাওয়া যায়। কার্বোহাইড্রেটকে গাঁজন প্রক্রিয়ায় ল্যাকটোব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়া ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে। যা রোগসৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াকে বাধা দেয়। সাধারণতঃ অসুস্থ, শিশু ও বয়স্ক মানুষ যাদের অন্ত্র খুবই দুর্বল; অপেক্ষাকৃত সেসব শ্রেণীর মানুষ বেশি সুবিধা পায় গাঁজায়িত খাবার থেকে। মায়ের দুধে বিরাজমান প্রিবায়োটিক এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ; ইহা স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়া তৈরিতে সহযোগিতা করে। কলাও একটি ভালো প্রিবায়োটিক, তবে কাংখিত ফলাফল পেতে দিনে ১০টি কলা খাওয়া দরকার।
বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় কিছু উল্লেখযোগ্য গাঁজায়িত খাবারের মধ্যে কেফি প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ পানীয়, যা বহুবিধ প্রকারের ব্যাকটেরিয়া ও ইস্ট এ ভরপুর। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার খনিজ ও ভিটামিন বিশেষ করে বি-ভিটামিনস ও ভিটামিন-কে সমৃদ্ধ। কেফির ১০ থেকে ১৫ গ্রাম কমপ্লিট প্রোটিন অর্থাৎ মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকুলের জন্য প্রয়োজনীয় ৯টি অ্যামাইনো এসিড সরবরাহ করে। শতাব্দী হতে শতাব্দী ধরে রাশিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপে কেফি প্রচলিত, বর্তমানে আমেরিকাতেও বেশ জনপ্রিয়।
সয়ারক্রাট : বাঁধাকপি হতে সহজেই ঘরে তৈরি করা যায়। এ খাবার শতাব্দী ধরেই মানুষ ব্যবহার করে আসছে। এখাবার উচ্চ আঁশ, ভিটামিন এ, সি, কে ও বিভিন্ন প্রকার বি-ভিটামিনস সমৃদ্ধ। তাছাড়া লৌহ, ম্যাংগানিজ, কপার, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়ামের ভাল উৎস। জার্মানিতে এর উৎপত্তি। মূল উপকরণ হচ্ছে বাঁধাকপি ও লবণ এবং পরিবেশনে সংগে সালাদও ব্যবহার করা হয়।
মিসু : জাপানিদের প্রচলিত গাঁজায়িত একপ্রকার পেস্ট-জাতীয় খাবার; যা গাঁজায়িত সয়াবিন ও শস্য বা বার্লি হতে তৈরিকরা এবং লাখ লাখ উপকারী ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ। প্রয়োজনীয় খনিজের উৎস ও বিভিন্ন বি-ভিটামিনস, ই, কে ও ফলিক এসিড সমৃদ্ধ। মিসু সুপের জন্য লবণের ভালো বিকল্প, সালাদ ড্রেসিং বা সস হিসেবে এবং মাছ, মাংস বা অন্যান্য খাবার মেরিনেটেড এর জন্য ব্যবহার করা যায়। বর্তমানে অন্যান্য দেশেও এটা জনপ্রিয় একটি গাঁজায়িত খাদ্য।
কিমচি: কোরিয়ানদের মসলাযুক্ত আচার জাতীয় একটি জনপ্রিয় গাঁজায়িত খাদ্য। অপেক্ষাকৃত ঝাল, এটাও গাঁজায়িত বাঁধাকপি বা মুলা হতে তৈরী করা হয়। ইহা ভিটমিনস বিশেষ করে ভিটামিন-এ, বি১, বি২, ভিটামিন-সি ও খনিজ যেমন লৌহ, ক্যালসিয়াম ও সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ। সাধারণত এককভাবে, ভাত বা নুডলস্, স্যুপের সাথে এবং বার্গারের উপরিভাগে সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য, বর্তমানে এটি চীন ও উন্নত বিশ্বের খাবার টেবিলে ধীরে ধীরে স্থান করে নিয়েছে।
কমবুচা : নন-অ্যালকোহলিক, সুগন্ধময় কার্বোনেটেড কালো চা। এ প্রক্রিয়ায় ইস্ট চিনিকে ভেঙে এলকোহল ও কার্বন-ডাই অক্সাইডে রূপান্তরিত করে। ব্যাকটেরিয়া অর্থাৎ এসিটোব্যাক্টর এলকোহলকে এসিটিক এসিডে পরিণত করে, যা টক স্বাদ যুক্ত করে। সম্ভবত রাশিয়ায় সর্বপ্রথম কমবুচার প্রচলন হয়, পরে তা আমেরিকা, জাপান, চীনসহ ইউরোপে বিস্তৃতি লাভ করে। কমবুচায় গ্লুকারিক এসিড থাকে, যা লিভার ভাল রাখে ও ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
টেম্পাহ্ : ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপবাসীদের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার। ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে জাভা অঞ্চলে এর প্রথম প্রচলন শুরু এবং পরবর্তীতে ১৯৮৪-১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে এর বাণিজ্যিক বাজারজাত শুরু হয়। টেম্পাহ্ বর্তমানে অনেক দেশের মানুষের পছন্দের খাবার। এটাও সয়াবিন থেকে গাঁজায়িত পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় এবং সাশ্রয়ী খরচে তৈরি করা যায়। টেম্পাহ্ উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ, ফলে নিরামিষভোজীদের জন্য শীর্ষ পছন্দসই একটি গাঁজায়িত খাবার। যখন টুকরা করে ডুবু তেলে ভাঁজা হয় তখন সুবাস ছড়ায়, মচমচে আকার ধারণ করে ও অনেকটা মাশরুমের মতো স্বাদ বিশিষ্ট হয়।
লাচ্ছি : টক দই থেকে তৈরি করা হয়। সাধারণত আহারের আগে বা ভোজনের সময় সাধারণত এটা গ্রহণ করা হয়। দেহের প্রয়োজনীয় প্রো-বায়োটিক ব্যাকটেরিয়া জোগাতে এটা শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে একটি জনপ্রিয় পানীয়। যতদূর জানা যায় পাকিস্তানের পাঞ্জাব এলাকায় এটির প্রচলন শুরু; পরে তা ভারতবর্ষ ও মধ্য প্রাচ্যজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
দধি : এ প্রক্রিয়ায় ল্যাকটোব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়া দুধের ল্যাকটোজকে গ্লুকোজ ও গ্ল্যাকাটোজ এ ভেঙে ল্যাকটিক এসিডে রূপান্তরিত করে; এবং টক স্বাদ যুক্ত করে। দধিতে থাকা জীবন্ত ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রে বিরাজমান ব্যাকটেরিয়াকে সতেজ, সবল ও কার্যকরী রাখতে বিশেষ অবদান রাখে। উল্লেখ্য, বিশ্বের ১১টি দেশ যথাক্রমে ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইন্ডিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মানুষ সবচেয়ে বেশি দধি খেয়ে থাকে।
ব্রেড : তাছাড়া কিছু কিছু রুটি ও গাঁজন প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত করা হয়। যেমন: সুরডাফ্ ; এ ধরণের ব্রেডের প্রচলন সর্বপ্রথমে ইউরোপে শুরু হয় এতে ল্যাকটোব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়া থাকে যা রুটির খামিকে গাঁজায়িত করে ও কটুগন্ধময় হয়। এ ধরনের রুটি প্রচলিত রুটির তুলনায় সহজে হজম হয়।
পান্তাভাত : উৎকৃষ্ট গাঁজায়িত খাদ্য। ১৭০০ শতাব্দী হতে ভারতবর্ষসহ এ অঞ্চলের কৃষ্টি, সভ্যতা, সং¯ৃ‹তির সঙ্গে পান্তাভাত জড়িত। যদিও পান্তাভাত গরিবের খাবার হিসাবে পরিচিত। পান্তাভাতকে ‘ঠা-া খাবার’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিশুদের জ্বর জ্বর ভাব হলে পান্তাভাত উপশম করতে সাহায্য করে। রাইস-ভাত হতে শক্তি ও পুষ্টি পাওয়া। তবে অলিগোস্যাকারাইড থাকায় রান্না করা হলে মানবদেহ তা পুরোপুরি হজম করতে পারে না বা হয় না। আবার ভাতে অনেক ধরনের অণুপুষ্টি ও খনিজ পদার্থ থাকে। রান্নায় তা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্তও হয়। ভাতসহ অন্যান্য দানাদার জাতীয় খাবারে ফাইটিক এসিড থাকে যা পুষ্টি-শোষণ বিরোধী ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করে। অর্থাৎ ওই ফাইটিক এসিড খাবার হতে পাওয়া অণুপুষ্টিসহ অন্যান্য খনিজ যেমন আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এগুলোকে আবদ্ধ অবস্থায় রাখে, অর্থাৎ শোষণে বাধা দেয়। তাছাড়া দেহের পরিপাক রসসহ পেপসিন, এমাইলেজ ও ট্রিপসিনকে বাধা দেয়।
ফারমেন্টেড রাইস বা পান্থা ভাত সাধারণত গড়পড়তা ৮-১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে ব্যবহার বা খাওয়া হয়। ফারমেন্টেড প্রক্রিয়ায় ফাইটিক এসিড, হাইড্রোলাইসিস অর্থাৎ পানির সঙ্গে রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া তৈরি-উৎপন্ন হয়; যা ভাতের গুণগত মান পরিবর্তন বা বৃদ্ধি করে; অর্থাৎ আবদ্ধকরা অণুপুষ্টিগুলোকে মুক্ত বা শোষণ সহজ করে। গবেষণা বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, ১০০ গ্রাম পান্তায় চালের প্রকারভেদে সাধারণ ভাতের চেয়ে সর্বোচ্চ ৫৫.৮৩ শতাংশ আয়রন বা লৌহ এবং ৪৯২ শতাংশ ক্যালসিয়াম বেশি পাওয়া যায়।
তাছাড়া শুধুমাত্র তিন ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলেই উল্লেখযোগ্য হারে মানব দেহে অণুপুষ্টি শোষণ ক্ষমতা বাড়ে বা শোষিত হয়। তবে ৪ থেকে ১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে তৈরিকরা প্রায় ৯০ ভাগ পান্তাভাতে ফেকাল কলিফর্ম পাওয়া যায়। সেজন্য পান্তাভাতে পানি ব্যবহারে নিরাপদ পানি ব্যবহার অপরিহার্য; সেজন্য ফুটন্ত গরম পানি ঠা-া করে ব্যবহারের মাধ্যমে এ সমস্যার উত্তরণ ঘটানো যায়।
এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার অন্যান্য গাঁজায়িত খাবার যেমন- মাছের সস, চিংড়ি পেস্ট, ভিনেগার, হরেক রকম আচার বাজারে সহজলভ্য। তাছাড়া বিয়ার ও মদ ফার্মেন্টেড শ্রেণীভুক্ত পানীয়, যা যুগ যুগ ধরে চিনিকে ফার্মেন্টেড প্রক্রিয়ায় মদ ও কার্বন-ডাই অক্সাইড এ রূপান্তরিত করে করা হয়। সম্পাদনা : ভিকটর রোজারিও