রাজধানীতে বাস থেকে পড়ে শিশুর মৃত্যু চালক-হেলপার আটক
সুজন কৈরী : রাজধানীর প্রগতি সরণিতে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে চলন্ত বাস থেকে পড়ে ১০ বছরের শিশু মরিয়ম আক্তারের মৃত্যুর ঘটনায় রাইদা পরিবহনের একটি বাসের চালক ও হেলপারকে আটক করেছে র্যাব। আটকরা হলেন- চালক রাজু মিয়া (২৫) এবং সহকারী ইমরান হোসেন (৩৩)।
শুক্রবার রাতে গাজীপুরের টঙ্গী এবং পাশের আব্দুল্লাহপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়।
গত ৯ নভেম্বর সকালে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা শিশু মরিয়মনে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। শিশুটির মাথার পেছনে জখমের চিহ্ন থাকার কথা জানিয়ে ভাটারা থানা পুলিশ জানায়, কোনো গাড়ির ধাক্কায় শিশুটি মারা গেছে বলে তাদের ধারণা।
র্যাব জানায়, মৃত শিশুটি কখনও রাস্তায় ফুল বিক্রি, কখনও লিফলেট বিলি, কখনও সাহায্য চেয়ে চলতো। বাবা-মার সঙ্গে থাকতো খিলক্ষেতের কুড়াতলী এলাকায়। ঘটনার দিন সাহায্য চাইতে ওই বাসটিতে উঠেছিল শিশুটি। তার বাবা রনি একজন প্রাইভেটকার চালক।
শনিবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঘটনার দিন সকালে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে রাইদা পরিবহনের বাস থেকে পড়ে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। এ সময় শিশুটির বাবা রনি মিয়া জানতে পারেন ভাটারা থানাধীন এলাকায় একটি মেয়ে শিশুর মরদেহ পাওয়া গেছে। ওইদিন বিকেলে তিনি মেয়ের মরদেহ শনাক্ত করেন। পরে এই ঘটনায় রাতেই অজ্ঞাত গাড়িচালককে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। এরপর র্যাব ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে। ঘটনাস্থল ও আশপাশের অর্ধশতাধিক সিসিটিভি ছাড়াও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে। এরপরই শিশুটির মৃত্যু রহস্য উদঘাটন হয়।
কমান্ডার আল মঈন বলেন, মরিয়ম ২০১৯ সালে স্থানীয় একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। তবে অর্থের অভাবে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সে বিভিন্ন জায়গায় অর্থ সহায়তা পেতে কুড়িল ও আশপাশের এলাকায় ঘোরাঘুরি করতো। ঘটনার দিন সকালে মরিয়ম বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় পথচারী ও বাস যাত্রীদের কাছে ঘুরে ঘুরে সাহায্য চাচ্ছিলো।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে মরিয়ম হেঁটে হেঁটে ফুটওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করে যমুনা ফিউচার পার্কের বিপরীত পাশে আসে। এরপর সে রাইদা সিটিং সার্ভিস নামক একটি পরিবহনের বাসে ওঠে। বাসটি সামনে যেতেই একজন পথচারীকে হাত দিয়ে ইশারা করতে থাকে। সিসিটিভি ক্যামেরার এক ফ্রেমের ঠিক পেছনে ভিকটিম মরিয়মকে আহত অবস্থায় পাওয়া যায়। সিসিটিভি ক্যামেরার অবস্থান এবং সময় বিবেচনা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এখানেই অকালে মৃত্যু হয় মরিয়মের।
মঈন বলেন, অর্থ সহায়তা চাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসটিতে উঠেছিল মরিয়ম। কিন্তু ভিকটিমের বাসে উঠা এবং পড়ে যাওয়ার কোনো সিসিটিভি ফুটেজ না পাওয়া যাওয়ায় ঘাতক বাসের চালক এবং হেলপারকে শনাক্ত করতে গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং নজরদারি আরও বৃদ্ধি করা হয়। এরপরই পৃথক অভিযান চালিয়ে অভিযুক্তদের আটক করা হয়। তারা নির্মম, হৃদয় বিদারক অকাল মৃত্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার দুজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ড্রাইভার রাজু এবং হেলপার ইমরান প্রতিদিনের মতোই রাইদা পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-৯০২২) নিয়ে পোস্তগোলা থেকে দিয়াবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করে। সকালে স্বল্পসংখ্যক যানবাহন ও যাত্রী কম থাকায় তারা দ্রুতবেগে গাড়ি চালাচ্ছিলো। বাসটি প্রগতি সরণি যমুনা ফিউচার পার্কে পৌঁছালে মরিয়ম বাস যাত্রীদের কাছে সাহায্য চাইতে গাড়িতে ওঠে। হেলপার ইমরান এ সময় যাত্রীদের কাছে ভাড়া নিচ্ছিলেন। ইমরান তখন চালককে বলেন, একজন ছিন্নমূল পথশিশু গাড়িতে উঠে অর্থ সাহায্য চাচ্ছে। তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে চালক রাজুকে গাড়ির গতি কমাতে বলেন। এ সময় মরিয়মকে দরজার কাছে গিয়ে নেমে যেতে বলা হয়। চালক রাজু কিছুদূর না যেতেই আবার থামতে বলায় বিরক্ত চালক বাসের গতি হালকা কমিয়ে, মরিয়মকে তাড়াতাড়ি নামতে বলে। মরিয়ম তাড়াহুড়ো করে নামার সময় হঠাৎ বাসচালক জোরে চালানো শুরু করেন। এতে মরিয়ম বাসের দরজা থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে গুরুতর আহত হয় এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে চালক গাড়ি না থামিয়ে দ্রুতবেগে দিয়াবাড়ির দিকে চলে যায়। এরপর পোস্তগোলায় হাসনাবাদের একটি বাস ডিপোতে গাড়িটি রেখে, দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বিষয়টি কাউকে না বলে আত্মগোপনে চলে যায়।
র্যাব জানায়, বাস চালক রাজু ছয় বছর রাইদা পরিবহনে গাড়ি চালাতো। পোস্তগোলা থেকে বাড্ডা-দিয়াবাড়ি পর্যন্ত প্রতিনিয়ত রাইদা পরিবহনের বাস চালক হিসেবে রাজু দায়িত্ব পালন করতেন। আর তার সহযোগী ইমরান আগে গার্মেন্টস শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ছয় মাস আগে ইমরান রাইদা পরিবহনে হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার আল মঈন বলেন, প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। আমরা অর্ধশতাধিক সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বাসটিকে শনাক্ত করেছি। বাসটির চালকের সঠিক কাগজপত্র ছিল কি-না জানতে চাইলে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে তাদের সব কাগজপত্র সঠিক ছিলো। এছাড়াও বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে আমরা তদন্ত করবো। আরেক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, বাসটি গেটকল সার্ভিস ছিলো। তাই মেয়েটিকে হেলপার প্রেসার করেছিল, যেন দ্রুত নেমে যায়। মৃত মরিয়ম বাস থেকে নামার সময় বাসের গতি ছিল প্রায় ৪০ কিলোমিটার। এতে সে বাস থেকে রাস্তায় পড়ে মারা যায়।