চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে তৈরি রাস্তায় মিললো মর্মর বিড়ালের নিথর দেহ
অর্থনীতি ডেস্ক : চট্টগ্রামের বায়েজিদ লিংক রোড থেকে অতি দুর্লভ মর্মর বিড়ালের (গধৎনষব ঈধঃ) মৃতদেহ পাওয়া গেছে। গত শনিবার বায়েজিদ লিংকরোডে মৃতদেহটি পড়ে থাকতে দেখেন শাতিল রহমান নামে সেখানে বেড়াতে যাওয়া এক ব্যবসায়ী। পরে তিনি প্রাণীটির ছবি তোলেন।
শাতিল রহমান জানান, সম্প্রতি তিনি চট্টগ্রামে ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে যান। ১৮টি পাহাড় কেটে একটি রাস্তা নির্মিত হয়েছে, সেটি শুনে গত শনিবার রাস্তাটি দেখতে বায়েজিদ লিংক রোডে যান তিনি। এ সময় পাহাড়ের গা ঘেঁষে রাস্তার শুরুতেই বিড়াল জাতীয় একটি প্রাণীর মৃতদেহ দেখতে পান তিনি। প্রাণীটিকে সচারচর চোখে পড়ে এমন প্রাণীর তুলনায় কিছুটা অন্যরকম মনে হলে তিনি সেটির ছবি তোলেন শাতিল রহমান।
পরে ছবিটি ডীপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেইক রেসকিউ ফাউন্ডেশন নামে ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করেন শাতিল। আর তাতেই হৈ-চৈ পড়ে যায়।
তিনি বলেন, লিংক রোডের শুরুতেই রাস্তার পাশে মৃতদেহটি পড়েছিল। গাড়িচাপায় প্রাণীটির মাথা পুরোপুরি থেঁতলে গিয়েছিল। তবে দেহ ছিল অক্ষত। দেখে মনে হচ্ছিল হয়তো রাতের কোনো এক সময় অথবা ভোরের দিকে তার মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, রাস্তা পার হতে গিয়েই সেটি গাড়ির নিচে পড়েছিল।
এদিকে ছবি তোলার পর প্রাণীটির বিষয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করে তিনি মর্মর বিড়ালের সঙ্গে প্রাণীটির মিল খুঁজে পান। পরে মর্মর বিড়ালের মৃতদেহ উল্লেখ করে ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করেন শাতিল রহমান।
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা ও তরুণ বন্যপ্রাণী গবেষক জোহরা মিলা জানান, অধ্যাপক ড. কাজী জাকের হোসেন রচিত “অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু দ্যা ওয়াইল্ডলাইফ অব বাংলাদেশ” বইয়ে বাংলাদেশের পার্বত্য বনাঞ্চলে মর্মর বিড়াল থাকার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। তবে বইটিতে সে বিষয়ে কোনো তথ্য-প্রমাণ দেওয়া হয়নি। এছাড়া স্বাধীনতার পর ২০১৩ সাল পর্যন্ত কোথায়ও প্রাণীটি জীবিতও দেখা যায়নি। ফলে আদৌ বাংলাদেশে প্রাণীটি আছে কিনা সেটি নিয়েও সন্দিহান ছিলেন বন্যপ্রাণী গবেষকেরা।
তিনি বলেন, পরে ২০১৩ সালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন-এর চেয়ারম্যান সীতেশ রঞ্জন স্থানীয় খাসিয়াদের কাছ থেকে বিড়াল গোত্রের একটি প্রাণী উদ্ধার করেন। পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনিরুল হাসান খান সেই প্রাণীটিকে মার্বেল ক্যাট বা মর্মর বিড়াল বলে চিহ্নিত করেন।
এ বিষয়ে তার রচিত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ক্যাট নিউজ জার্নালে। এছাড়া ড. মনিরুল রচিত ফটোগ্রাফিক গাইড টু ওয়াইল্ডলাইফ অব বাংলাদেশ বইয়েও তিনি মর্মর বিড়াল সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য তুলে ধরেছেন। এছাড়া ২০১৭ সালে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স-এর পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ে মার্বেল বিড়ালের ছবি পাওয়ার তথ্য রয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে মর্মর বিড়াল সম্পর্কে ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, স্বাধীনতার পর ২০১৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত দেশে মর্মর বিড়ালকে কেউ জীবিত দেখেনি, শুধু চামড়া পাওয়া যায়। তাই অনেকে মনে করতেন প্রাণীটি দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ২০১৩ সালে শ্রীমঙ্গলে একটি মর্মর বিড়াল উদ্ধার হওয়ায় বন্যপ্রাণী গবেষকদের ধারণা পাল্টে যায়।
চিরসবুজ ও আর্দ্র পাতাঝরা বন অর্থাৎ সিলেট, ময়মনসিংহ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীর বনে মর্মর বিড়ালের বিচরণ রয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, চট্টগ্রামের গহীন বনাঞ্চলে মর্মর বিড়াল রয়েছে সেটি জানা যায়। কিন্তু শহরের এত কাছে মর্মর বিড়ালের উপস্থিতি অভাবনীয়। প্রাণীটি স্বভাবগতভাবে নিশাচর, বৃক্ষচারী, নিঃসঙ্গ ও রহস্যময়। এরা বেশিরভাগ সময়ই গাছে কাটায় তবে খাবারের সন্ধানে মাটিতে নেমে আসে। বুনো ছোট পাখি, পাখির ডিম ও বাচ্চা, বুনো খরগোশ, বড় ইঁদুর, ব্যাঙ ইত্যাদি খায়। একটি মা মর্মর বিড়াল ৬৬ থেকে ৮২ দিন গর্ভধারণের পর একসঙ্গে এক থেকে চারটি বাচ্চা দেয়। ২১ মাসে বাচ্চাগুলো পরিণত হয়ে ওঠে। পরিণত মর্মর বিড়াল নাকের ডগা থেকে লেজ পর্যন্ত তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট হয়ে থাকে। তবে এই পুরো দৈর্ঘ্যের লেজটাই প্রায় অর্ধেক। এদের গড় আয়ু প্রায় ১২ বছর।
তিনি জানান, ক্রমাগত বন ধ্বংসের কারণে খাদ্য ও বাসস্থান হারিয়ে সুন্দর এই প্রাণীটি দেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। বিড়াল গোত্রের এই প্রাণীটি বাংলাদেশের বাইরে ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, মণিপুর, মেঘালয়সহ পাহাড়ি অঞ্চলে এবং মিয়ানমার, নেপাল, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশের বনাঞ্চলে এখনও টিকে আছে।
অন্যদিকে, জোহরা মিলা জানান, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) রেডলিস্ট ২০১৫-তে প্রাণীটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে প্রাণীটি সম্পর্কে তথ্য অপর্যাপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়। গ্লোবাল রেডলিস্ট অনুযায়ী প্রাণীটি প্রায় হুমকিগ্রস্ত (ঘবধৎ ঞযৎবধঃবহ)। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ এর তফসিল-১ অনুযায়ী মর্মর বিড়াল সংক্ষিত প্রাণী। তাই এটি শিকার, হত্যা বা এর কোনো ক্ষতিকরা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সূত্র : ঢাকা ট্রিবিউন, সময় নিউজ অনলাইন। গ্রন্থনা : শোভন দত্ত