আবার এক লাখ কোটি টাকা ছাড়াল খেলাপি ঋণ
অর্থনীতি ডেস্ক : সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। জুন শেষে খেলাপি ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ খেলাপি ছিল সে সময়। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ টাকার অঙ্কে বাড়লেও শতকরা হিসাবে কমেছে ০.০৬ শতাংশ।
খেলাপি কমাতে নানা আলোচনার মধ্যে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ আবার এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তবে শতকরা হারের বিবেচনায় বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে খেলাপির পরিমাণ গত তিন মাসে কিছুটা কমেছে।
বরাবরের মতো হালনাগাদ তথ্যেও দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার বেশি। বিপরীতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোতে তা কিছুটা কম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ।
জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ১৩ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৩ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ টাকার অঙ্কে বাড়লেও শতকরা হিসাবে কমেছে ০.০৬ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকা এর আগেও ছিল। ২০১৯ সালের মার্চ শেষে প্রথমবারের মতো অবলোপনের হিসাব বাদে খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে হয়ে যায় এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা।
তখন সরকার খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দেয়। এতে খেলাপি ঋণ এক লাফে কমে আসে ৮০ হাজার কোটি টাকার ঘরে।
করোনা ভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর ২০২০ সালে কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত না করার নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বাড়েনি বললেই চলে। চলতি বছরের শুরুতে গত বছরের মতো ঢালাও শিথিলতা না দিয়ে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ছাড় দেয়া হচ্ছে।
নির্দেশনা অনুযায়ী যেসব মেয়াদি ঋণ চলতি বছরের মার্চ ও জুনের মধ্যে পরিশোধ করার কথা ছিল ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে তা আগামী ডিসেম্বরে পরিশোধ করলে তাকে খেলাপি না করলেও চলবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সুবিধা শিথিল করার পর থেকে খেলাপি ঋণ আবার বাড়তে শুরু করেছে।
ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বিসমিল্লাহ, হলমার্কসহ ব্যাংক খাতের একাধিক বড় ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। তদন্তের নামে দিনের পর দিন পার হয়ে যায়। এজন্য অন্য খেলাপি গ্রাহক মনে করে তারা যদি টাকা শোধ করতে না পারে তাদের কিছু হবে না।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো ভালোভাবে যাচাই-বাছাই না করে অনেককে ঋণ দেয়। খেলাপি ঋণের ঘাটতি পোষাতে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দেয়ার ফলে ব্যাংকগুলোর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে এ ধরনের সুবিধা সবসময়ই তাদের দেয়া হবে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৬ হাজার ৮০২ কোটি টাকা।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সে হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা।
সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বাংলাদেশ ডেভলপমেনট ও বেসিকে এ ছয় ব্যাংক মোট ঋণ বিতরণ করে ২ লাখ ১৯ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ২০ দশমিক ০৭ শতাংশ।
জুন শেষে এই ছয় ব্যাংকের ঋণ ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। ওই সময় খেলাপি ছিল ৪৩ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা । শতকরা হিসেবে তা ছিল ২০ দশমিক ৬২ শতাংশ।
বছরের প্রথম প্রান্তিক জানুয়ারি-মার্চ শেষে ২ লাখ ৭ হাজার ৭৭১ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে খেলাপি ৪৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। মোট ঋণের ২০ দশমিক ৯১ শতাংশ।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ছিল ৪২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। ওই সময় বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা।
বিশেষায়িত কৃষি, প্রবাসী কল্যাণ ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন এ তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হয়েছে ৩ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। এ অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। তারা বিতরণ করেছে মোট ৩২ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা।
জুন শেষে এ তিন ব্যাংকের ঋণ ছিল ৩২ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। এসময়ে খেলাপি হয় ৩ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। মার্চ শেষে ৩০ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে খেলাপি ছিল চার হাজার ৮৬ কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে ৯ লাখ ২৮ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৫০ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
জুন শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ ছিল ৯ লাখ ৪ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। ওই সময় খেলাপি ছিল ৪৯ হাজার ১৯১ কোটি টাকা । শতকরা হিসেবে ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
জানুয়ারি-মার্চ শেষে ৮ লাখ ৭৯ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে খেলাপি ছিল ৪৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ ছিল।
গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৪০ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা।
বিদেশি মালিকানার নয় ব্যাংকের খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ১২ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ হয় ৬৫ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। জুন শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ছিল ২ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। আর মার্চ শেষে ছিল ২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। সূত্র : নিউজবাংলা