পোশাকের দাম নির্ধারণ করলে বায়ারদের মুখফিরে নেয়ার শঙ্কা
মো. আখতারুজ্জামান : তৈরি পোশাক পণ্যের উৎপাদন ব্যয় যে হারে বাড়ছে সেই তুলনায় দাম পাচ্ছে না উদ্যোক্তারা। এই অবস্থান থেকেই বেড়িয়ে আসতে পণ্যের সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণের পরিকল্পনা করছে দেশের তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইএ ও অন্যান্য সংগঠনের নেতারা। তবে এই উদ্যোগ নিয়ে বায়ারা মুখফিরিয়ে দেয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টর।
দাম নির্ধারণ করলে ছোট ছোট উদ্যোক্তরা ক্ষতিমুখে পড়বে। অন্যদিকে বায়ার পণ্যের দামের বিষয়ে যখন অন্যদেশের সঙ্গে তুলনা করবে তখন তারা আমাদের রেখে অন্যখানে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
যদিও পোশাক মালিকদের নেতারা বলছেন, এখন পণ্যের দাম বেশি নেয়ার সময়। তারা উদ্যোক্তাদের কম দামে পণ্য বিক্রি না করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তৈরি পোশাক বিজিএমইএ সভাপতি মো. ফারুক হাসান জানান, আমরা পণ্যের দাম নির্ধারণের বিষয়ে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছি এটা সময়সাপেক্ষ। সেইসঙ্গে একটু কঠিন কাজ। আমরা দাম নির্ধারণে বেশি কিছু বিষয়কে সামনে নিয়ে এসে করতে চাইছি। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পণ্যের উৎপাদন ব্যয়। আমরা নির্ধারণ করে দিবো যাতে করে সেই দামের নিচে কেউ বিক্রি না করে। আমরা ব্যবসা করতে এসেছি, লোকশান করতে নয়। আসলে প্রকৃতপক্ষে দাম নির্ধারণ করা তো অনেক কঠিন কাজ। কারণ বিভিন্ন ধরনের আইটেম বিভিন্ন ধরনের দাম হবে এটাই সাভাবিক। এই বিষয়টা নিয়ে বিকেএমইএ, বিটিএমইএ-সহ সবার সঙ্গে কথা বলতেছি। সেইসঙ্গে স্টেকহোল্ডাদের সঙ্গে আলোচনা করে আগাবো।
তিনি বলেন, আমরা এমনভাবে পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে চাই যাতে কোনো উদ্যোক্তা ক্ষতির মুখে না পড়ে। দাম নির্ধারণের বিভিন্ন দেশের যে অভিজ্ঞতা রয়েছে সেই বিষয়ে দেখছি।
জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২২৭ ধরনের তৈরি পোশাক রপ্তানি করছে। এই তালিকা থেকে সর্বাধিক রপ্তানি হয় এমন পাঁচ ধরনের পোশাকের সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণের চেষ্টা করছে তৈরি পোশাকখাত সংশ্লিষ্ট মালিকদের সংগঠন বিজেইমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমইএ। পণ্যগুলো হলো- ট্রাউজার, টিশার্ট, সোয়েটার, শার্ট ও আন্ডারওয়্যার।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশন (বিজিবিএইচএ) এর সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন বলেন, দুই পক্ষের দরকষাকষি হবে এটাই ব্যবসার নিয়ম। আমরা দর নির্ধারণ করে দিবো ভালো কথা। যদি এর নিচে কেউ বিক্রি করতে চায় তাহলে কি হবে? আসলে দাম নির্ধারণ করে দিলে ক্রেতা ছুটে যাবে। কারণ তারা যদি কোনো দেশে এর চেয়ে কম দামে পণ্য পায় তাহলে আমাদের এখানে থেকে নিবে কেনো।
তবে কারখানাগুলোকে চাপে মরাখার জন্য এটা করা যেতে পারে। সেটা হচ্ছে কারখানাগুলোর স্টান্ডাড নির্ধারণ করে তাদের পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। এরপর ক্রেতাদের ক্যাটাগরি নির্ধারণ করতে হবে। আর এটা করে দেয়ার পর বোঝা যাবে যে আমাদের বাজার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। তবে এভাবে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
ভারতের উদাহরণ টেনে ইফতেখার হোসেন বলেন, ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল এই চার বছর ভারত তাদের তৈরি পোশাক পণ্যের সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করে। এই সময় ভারতে থেকে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে অন্যদেশে চলে যায়। ফলে তারা বাদ্ধ হয়ে সর্বোনিম্ন দাম উঠিয়ে নেয়।
গ্রাহকদের বিভিন্ন মতামত থাকবে। এখান থেকেই বিক্রেতা তার ক্রেতাকে বেঁচে নিবে। আর যদি নির্ধারণ করে দেয়া হয় ক্রেতাদের তখন মতামত দেয়ার জায়গা তেমন একটা থাকবে না। ক্রেতার যদি দাম করার স্বাধিনতা না থাকে তাহলে সে এখানে আসতে চাইবে না।
তিনি বলেন, আমরা যদি ভাবি যে ক্রেতারা আমাদের উপর নির্ভরশীল তাহলে ভুল হবে। তারা যখন দেখবে যে এখানে ভালো করতে পারছে না, তখন তারা অন্য দেশে চলে যাবে। সেইসঙ্গে আমাদের ভাবতে হবে, বর্তমানে ক্রেতাদের যে চাহিদা রয়েছে কিছুদিন পরে সেটা নাও থাকতে পারে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, গত অর্থবছরে পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ১০৭ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়েছে ট্রাউজার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭২ কোটি ডলার এসেছে টিশার্ট রপ্তানি থেকে। ৪০ কোটি ডলারের কিছু বেশি আয় এসেছে সোয়েটার রপ্তানি থেকে। অন্য প্রধান দুই পণ্যের মধ্যে শার্ট রপ্তানি হয়েছে সাড়ে ২০ কোটি ডলারের। আন্ডারওয়্যার রপ্তানি হয়েছে ১৮ কোটি ডলার।
২০ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের এ সংগঠনের সভাপতি মো. ফারুক হাসান বলেছিলেন, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা বেড়েছে, ক্রয়াদেশও আসছে বেশি; এমন পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে রপ্তানির অর্ডার না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ফারুক হাসান বলেন, আমি পোশাকখাতের উদ্যোক্তা ভাই বোনদের কাছে অনুরোধ করব, আপনারা পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হবেন। কোনও অবস্থাতেই যেন স্বাভাবিক উৎপাদন মূল্যের চেয়ে কম দামে নেগোশিয়েট না করি। বিজিএমইএ সভাপতি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে দাম বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আপনারা পোশাকের মূল্যের বিষয়টিতে আরও সংবেদনশীল হন। বর্তমানে সুতাসহ অন্যান্য কাঁচামাল ও ফ্রেইট খরচ বাড়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরবরাহকারীদের সঙ্গে ন্যায্যতারভিত্তিতে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করুণ। এ প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে ক্রেতাদের সহযোগিতা আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।