ছাদে ছাগল পালন মেটাবে দেশে মাংসের চাহিদা
মতিনুজ্জামান মিটু : শহরে ছাগল পালনের জন্য বাসার ছাদকে ব্যবহার করা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. দেবাশীষ দাশ বলেন, যমুনা পাড়ি জাতের ছাগল পালন নিরাপদ ও লাভজনক হতে পারে। ছাদে পালনের জন্য ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলই উপযুক্ত হবেনা।
এদেশে যমুনা পাড়ি বা পুরি জাতের ছাগল রাম ছাগল বলে পরিচিত। যমুনাপুরী জাতের ছাগল উত্তরপ্রদেশের যমুনা, গঙ্গা ও চম্বল নদীর মধ্যবর্তী এটোয়া জেলায় এবং আগ্রা ও মথুরা জেলায় দেখা যায়। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় এ জাতের ছাগল পাওয়া যায়। এরা মাংস ও দুধ উভয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। রাম ছাগল বা যমুনাপাড়ি ছাগলের শরীরের রং সাদা, কালো , হলুদ, বাদামী এবং বিভিন্ন রংয়ের সংমিশ্রণে হয়ে থাকে। রাম ছাগলের শরীরের গঠন সাধারনত লম্বাটে হয়। এদের পা খুব লম্বা এবং পিছনের পায়ের পেছন দিকে লম্বা লোম থাকে যা রাম ছাগলের অন্যতম বৈশিষ্ট। এদের কান লম্বা প্রকৃতির ও ঝুলন্ত হয়।
সাধারনত ৭থেকে ১০ ইঞ্চির অধিক ঝুলন্ত কান এদের প্রধান বৈশিষ্ট। এ জাতের ছাগীর ওলান বেশ বড়, সুগঠিত ও ঝুলন্ত। ওলানের বাটগুলো মোটা ও লম্বা। মাথার শিং চ্যাপ্টা ও লম্বা হয়ে থাকে। এদের শরীরের উচ্চতা ৩২ থেকে ৪০ ইঞ্চি বা এর বেশি হতে পারে। একটি পূর্ণবয়স্ক যমুনাপাড়ী পাঁঠার ওজন ৬০থেকে ৯০ কেজি এবং ছাগীর ওজন ৪০ থেকে ৬০ কেজি পর্যন্ত হতে থাকে। এই প্রজাতির প্রাপ্তবয়স্ক ছাগলের গড় ওজন ৭০ থেকে ৯০ কেজি এবং ছাগীর ওজন ৫০ থেকে ৬০ কেজি পর্যন্ত হয়।
এরা অত্যান্ত কষ্টসহিষ্ণু ও চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে থাকে। এরা সাধারণত দেরিতে প্রাপ্ত বয়োস্ক হয়ে থাকে। যমুনা পাড়ি জাতের ছাগী বছরে একবার বাচ্চা দেয় এবং প্রতিবার ১ থেকে ২ টি বাচ্চা প্রসব করে। যমুনাপাড়ি জাতের ছাগলের দুধ দেওয়ার ক্ষমতা দেশি জাতের ছাগলের তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। এরা প্রতিদিন প্রায় ১.৫ থেকে ২ কেজির বেশি দুধ দেয়। এ জাতের ছাগলের দুধে প্রায় ৪ থেকে ৫ ভাগ ফ্যাট থাকে। এ জাতের মাংশ ব্লাকবেঙ্গল জাতের ছাগলের মতো সুস্বাদু নয় এবং চামড়াও উন্নত মানের নয়। তবু দুধ ও মাংশ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে এদেশে যমুনাপাড়ি জাতের ছাগল পালন করা হয়। এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্লাকবেঙ্গল ছাগলের চেয়ে কম হয়ে থাকে।
জামুনাপারি বা রামছাগল জাতের ছাগলের দুধ এবং মাংস দুটিই ভাল দামে বিক্রি হয়। উন্নত জাতের ছাগল হওয়ায় ওজন বেশি হয় এবং বিক্রি করার সময় ভাল দাম পাওয়া যায়। এ জাতের ছাগলের বাচ্চার বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং ভালো দামেই বিক্রয় হয়। এই জাতের ছাগল পালন করে একজন খামারি কম খরচে সহজেই খামারের উপার্জন বাড়াতে পারবেন। ছাগল গাছের পাতা খায়, তাই এই প্রাণীকে দানাশস্যও কম দিতে হয়। আকারে বড় হওয়ায় বেশী পরিমাণ মাংস পাওয়া যায় এই প্রজাতির ছাগল থেকে।
রংপুরের কাউনিয়ার উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: মনোজিৎ কুমার সরকার জানান, ছাদ বাগানের জন্য প্রচুর পরিমাণে জৈবসার প্রয়োজন, যা ছাগলের মল থেকে সহজেই পাওয়া সম্ভব। ছাদ বাগানের লতাপাতা, বাসার উচ্ছিষ্ট খাদ্য, ছাগলের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। উচ্চতা ছাগল পালনের জন্য কোন সমস্যা হবে না।
ছাগল শুধু গরিবের গাভী নয় ধনীদেরও গাভী। ছাগল উৎপাদন করে গ্রামের দরিদ্র মানুষ আর ভোগ করে শহরের বিত্তশালী মানুষ। ছাগলের মাংসের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে মূল্য ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ছাগল পালন করা খুবই সহজ কাজ, খাদ্য খরচ কম, রোগ বালাই কম, বংশবৃদ্ধির হার বেশি, ছাগল ছোট প্রাণী হওয়ায় ছাদে উঠানো ও নামানো সহজ হবে। ছাদ বাগানের জন্য প্রচুর পরিমাণে জৈবসার প্রয়োজন, যা ছাগলের মল থেকে সহজেই পাওয়া সম্ভব। ছাদ বাগানের লতাপাতা, বাসার উচ্ছিষ্ট খাদ্য, ছাগলের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। উচ্চতা ছাগল পালনের জন্য কোন সমস্যা হবে না।
প্রতিটি ছাগলের জন্য ৫ থেকে ৬ বর্গফুট জায়গা দরকার। ছাগলের সংখ্যা ও ছাদের আকার অনুযায়ী ঘর তৈরি করতে হবে। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় ও ঠা-া থেকে রক্ষা করে আরামদায়ক পরিবেশের দরকার হবে। ছাগলের সংখ্যা অনুযায়ী কম খরচে মাচা তৈরি করতে হবে। ছাদের নিরাপত্তা প্রাচীর ৩ থেকে ৪ ফুট উঁচু করে বানাতে হবে, যাতে লাফিয়ে পড়ে না যায়। প্রয়োজনে প্লাস্টিক নেট ব্যবহার করা যাবে। ছাদে ঘর তৈরির জন্য সিমেন্ট সিট ব্যবহার করা ভাল, ঘর ঠা-া থাকবে, প্রয়োজনে ককসিট দিয়ে ছাদ দিতে হবে। ঘর দোচালা করাই ভাল।
উপযুক্ত জাত
ছাদে পালনের জন্য ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলই উপযুক্ত, আকারে মাঝারি, কষ্টসহিষ্ণু খাদ্য গ্রহণে বাদ-বিচার করে না, রোগবালাই কম, বছরে ২ বার বাচ্চা দেয়। দেশি ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের রং কালো, সাদা-কালো, খয়েরি হতে পারে। শিং ও কান ছোট, ওলান বড়। ২০০ থেকে ৩০০ মিলি. দুধ দেয়। ২ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত দুধ দেয়। প্রথমবার ছাগী ১টি পরে ২ থেকে ৩টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়। ছাগল জবাই করার পর ৪৫ থেকে ৪৭শতাংশ মাংস পাওয়া যায়। ছাগী গরম হলে প্রজনন করানোর জন্য সঙ্গে ১টি পাঠা পালন করা যেতে পারে অথবা পাঠা পালনকারীর মোবাইল নং রাখতে হবে। প্রজননের ঝামেলা এড়াতে শুধু খাসি সংগ্রহ করে পালন করা যেতে পারে।
প্রতিটি ছাগলের জন্য দৈনিক ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম দানাদার খাদ্য মিশ্রণ, ১ থেকে ২ কেজি কাঁচা ঘাস বা লতাপাতা ও ১ থেকে ১.৫ লিটার পানি সরবরাহ করতে হবে।
ছাগলকে বেশি পরিমাণে ভাত, পোলাও, চাল, গম, আলু খাওয়ালে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়বে। নবজাত বাচ্চাকে প্রতিটি ৩০০ থেকে ৫০০ মিলিলিটার দুুধ খাওয়াতে হবে। প্রয়োজনে মিল্ক রিপ্লেসার খাওয়াতে হবে। দুধ ছাড়ানোর পর পরিমাণ মতো দানাদার খাদ্য খাওয়ালে গড়ে দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ গ্রাম করে ওজন বৃদ্ধি বাড়বে। এক বছরের মধ্যে ১৮ থেকে ২০ কেজি ওজনের হতে পারে। পাঠাকে দানাদার ও ঘাসের পাশাপাশি দৈনিক ২০ গ্রাম অংকুরিত ছোলা দেয়া উচিত।
ছাদে ছাগল পালনে সবুজ ঘাসের চাহিদা পূরণ করতে খুব সহজেই হাইড্রোপনিক ঘাসের চাষ করা যায়। এ পদ্ধতিতে মাটি ও জমি ছাড়াই ঘাস উৎপাদন করা হয়, সব ধরনের খামারি এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন। উৎপাদিত ঘাসে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান রয়েছে। উৎপাদন খরচও খুব কম, প্রতি কেজি ২ থেকে ৩ টাকা। ঘরের ছাদে, ঘরের ভেতরে, বারান্দায়, মাটির পাতিল, পানির বোতল ইত্যাদি উপযুক্ত জায়গায় উপযুক্ত বীজ যেমন : ভুট্টা, গম, ছোলা, সয়াবিন, খেসারি, মাসকলাই এবং বার্লি প্রভৃতি বপন করা যেতে পারে।