চাহিদা থাকলেও ফসল হিসেবে চাষ হয় না মেহেদী
মতিনুজ্জামান মিটু : এর রঙে হাত না রাঙালে ঈদ বা বিবাহের কোনটির আমেজই পাওয়া যায়না। ইংরেজী নাম হিন্না, যা আরবি হিন্না থেকে এসেছে। বাংলায় মেহেদী, মেহেন্দী ও মেন্দি নামে ডাকা হয়। মেহেদী গাছের আদিনিবাস হচ্ছে মূলত উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া। এটি উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের উদ্ভিদ। মেহেদী সাধারণত মরু অঞ্চল ও সেমি-ড্রাই অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভাবেই জন্মে থাকে। এসব অঞ্চলের জলবায়ু মেহেদী গাছ জন্মানোর জন্য অনুকুল। অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে মিশর, ভারত, লেভেন্ডা, পারসিয়া, কুর্দিস্থান, সিরিয়া এবং আফ্রিকার উঞ্চমন্ডলীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়।
আদিম যুগ থেকে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে মেহেদী গাছ ও পাতা। বিশ্বের প্রায় সব দেশে এটি জন্মে। আদিকাল থেকেই রঙের জন্য ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশসহ মেহেদী গাছের চাষ হয়ে আসছে। বাংলাদেশের সর্বত্র বাড়ির আঙিনায় মেহেদী গাছ ভাল জন্মে। ঢাকা মহানগরসহ দেশের কোন কোন শহরে রাস্তার পাশে বসে মেহেদীর ডালসহ পাতা বিক্রি করতে দেখা যায়। তবে এখনো দেশে বাণিজ্যিকভাবে চির পরিচিত এগাছের চাষ হয়না। নেই কোনো স্ট্যাডি এবং গবেষণাও। নেই এগাছের হিসাব। নিধনের কারণে দিন দিন গাছটি হুমকির মুখে পড়ছে। ভিষণ উপকারী এই গাছ যেন অকালেই হারিয়ে না যায় তাই উচিত এই গাছের রক্ষণাবেক্ষণের দিকে নজর দেওয়া।
মেহেদি বা হিন্না ছোট গোলাপি, লাল বা সাদা ফুলবিশিষ্ট এক ধরনের সপুষ্পক গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। উদ্ভিদ হিসেবে চিরসবুজ। বংশবিস্তার করে অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে। এই গাছের পাতা থেকে লালচে রং উৎপন্ন হয়, যা প্রাচীনকাল থেকে মানুষের ত্বক, চুল, নখ; এমনকি পশুর চামড়া ও পশম রঙিন করার কাজেও ব্যবহার হয়ে আসছে। ঈদ, পূজা, বিয়ে এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে শিশু-কিশোর ও নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে মেহেদি রঙের বর্ণিল নকশায় তাদের হাত ও আঙুল সজ্জিত করে। বিয়ে অনুষ্ঠানের শুরুতেই কনের আঙুল, হাত ও দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মেহেদি রঙে সাজিয়ে তাকে বিশেষভাবে গোসল করানো হয়।
মেহিদী গাছ উচ্চতায় ৭ থেকে ৮ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। গাছের বাকলের রঙ নীলচে বাদামি বর্ণের হয়। মেহেদী গাছে ফুল জন্মে। যা অত্যন্ত সুগন্ধময়। একটি মেহেদী গাছের লম্বা পুষ্পদন্ডে গুচ্ছাকারে অনেকগুলো সাদা বা হালকা গোলাপির ফুল একত্রে হয়। বর্ষাকালে মেহেদী গাছে ফুল আসে। মেহেদী ফুল থেকে ও সুগন্ধী দ্রব্য তৈরি করা হয়। মেহেদী গাছে ফল হয়। ফলগুলো প্রথমে সবুজ এবং পাঁকলে লাল বর্ণ ধারণ করে। মেহেদী গাছে ফুল এবং ফল একই সময়ে আসে। ফল পেঁকে গেলে পরবর্তীতে তা বীজে রূপ নেয়।
ফলগুলো ধূসর বর্ণে রূপ নিলে তখন ফলের ভেতর ৫৮ থেকে ৫৯ টি বীজ পাওয়া যায়। সঠিক ভাবে কাটিং করতে জানলে মেহেদী গাছের একবারের বীজ থেকে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ টি মেহেদী চারা জন্মানো সম্ভব। সাধারণত সব ধরণের গাছের পাতায় কিন্তু রঙ হয় না। শুধুমাত্র মেহেদী গাছের পাতাতেই এ আশ্চর্য গুণটি রয়েছে। এর পেছনে কারণ হচ্ছে লাসোন নামক এক প্রকার রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতি। এই রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতির কারণেই মেহেদী থেকে রঙ পাওয়া যায়। মেহেদী পাতাতেই মূলত এই লাসোন পদার্থটি থাকে। যে মেহেদী গাছের পাতায় লাসোন বেশি সে গাছে বীজ কম ফলে।
মেহেদীর ব্যবহার সুপ্রাচীন। নানাভাবে এটি ব্যবহার হয়ে আসছে। খ্রীষ্টপূর্ব ২১০০ সালে ব্যাবিলীয়ান এবং সুমেরীয় সভ্যতার প্রথম ভাগ থেকেই মেহেদী ব্যবহারের নিদর্শণ রয়েছে। মোঘল আমলে ভারতবর্ষের রাজা-রাণীরা উন্নতির প্রতীক হিসেবে নিজেদের দেহসজ্জায় মেহদী পাতা ব্যবহার করতেন। ক্লিওপেট্রার সময়েও রাণী সহ মিশরীয় সাধারণ মহিলারা মেহদী দিয়ে হাত-পা রাঙাতেন। এমনকি সেসময়কার পুরুষরাও তাদের দাড়ি ও প্রিয় ঘোড়ার লেজ রাঙাতে ব্যবহার করতেন মেহেদি।
মেহেদী পাতাকে ঘিরে বিভিন্ন দেশ-বিদেশ এবং গ্রাম বাংলায় অনেক প্রচলিত প্রথা রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় শুভ প্রতীক হিসেবে মানা হয়। তাই যেকোন উৎসব-পার্বণে বিশেষ করে বিবাহের মতো অনুষ্ঠানে এটি খুব ব্যবহার করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই মেহেদী বিয়ে এবং মেয়েদের ফার্টিলিটি উৎযাপনের একটি দারুণ অনুসঙ্গ। বাংলাদেশে ঈদ এবং বিবাহের অনুষ্ঠানে মেহেদির ব্যবহার আবিশ্যিকরূপে প্রচলিত।
ভারতীয় বিবাহতেও মেহেদী ব্যবহারের আবশ্যকতা লক্ষ্য করা যায়। সেসময় বাংলাদেশ সহ গোটা ভারতবর্ষে মেহেদী ছাড়া কোন বিবাহ উৎসব সম্পন্ন হওয়ার কথা চিন্তাই করা যেত না। একারণে ক্রমে বিবাহের সময় মেহিদী দেওয়া এক উৎসবে রূপ নেয়। বিভিন্ন জায়গায় এই উৎসবকে পালন করতে ‘মেহিন্দি’ নামক অন্ষ্ঠুানের আয়োজন করা হয়। সেদিন বর-কনেকে হাতভরে মেহেদী পরানো হয়। মেহেদী পাতা বাটা বা পেস্ট আজও মেয়েদের হাত রাঙানোর এক অনন্য উপাদান।
সৌন্দর্য্যবর্ধক মহেদী গাছ খুবই উপকারী উদ্ভিদ। এতে রয়েছে অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিইনফ্লামেটরি, কুলিং, হিলিং, সিডেটিভসহ অনেক গুণ, যা দেহ ও মনের বিভিন্ন রোগ প্রশমন করে। মেহেদী গাছের ছাল থেকে শুরু করে এর পাতা, বীজ, ফুল-ফল সবকিছুই বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করা যায়। মেহেদী গাছের পাতা ও ছালে রয়েছে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান। পাতা ও ছালে রয়েছে, অনুজীব ধ্বংসী রঙ্গিন ন্যাথোকইনোন দ্রব্য, প্রচুর পরিমাণ ট্যানিন, গ্লাইকোসাইড, স্টেরল ও টার্পিন। এছাড়াও হেনা অর্থ্যাৎ মেহেদী গাছের পাতায় রয়েছে রঞ্জক পদার্থ লাসোন এবং টেনিন উদ্ভুত হেনোটনিক এসিড।
মেহেদী বীজ থেকে পেট্রোলিয়াম ইথার শোষনের মাধ্যমে উচ্চ-সান্দ্রার তৈল পাওয়া যায়। এই তেলে বিহেনিক, অ্যারাসিডিক, স্টিয়ারিক, পালমেটিক, ওলিক ও লিনোলিক এসিড বিদ্যমান। যা মানব শরীর এবং স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী।
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সুগন্ধি উদ্ভিদ রোজমেরি বা ল্যাভেন্ডার। বর্তমানে বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী তৈরিতে প্রচুর ব্যবহৃত হচ্ছে মেহেদী গাছের পাতা এবং তেল। মেহেদীতে রয়েছে এন্টিফাঙ্গাল, এন্টি-ইনফ্লেমেটরী, কুলিং ও হিলিং, এন্টিইরিটেন্ট ও সিডেটিভ গুণাগুণ। একারণে মেহেদী পাতা, গাছের ছাল ইত্যাদি জীবাণুনাশক এবং পোকা দমনে ব্যবহার করা হয়।
এছাড়াও মেহেদী গাছ আরও বহুবিধ উপায়ে ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকালে মেহেদী ফুল থেকে বিভিন্ন সুগন্ধী দ্রব্য প্রস্তুত করা হতো। মাঝে বন্ধ হয়ে গেলেও বর্তমানে এটি আবার শুরু করা হয়েছে। মেহেদী পোশাক এবং চামড়া ভাল রাখতে সাহায্য করে। এগুলোয় যাতে পোকার আক্রমণ না ঘটে তাই ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন গাছের চারা বা জিনিসের পোকা নিরোধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
রূপচর্চায় মেহেদী পাতার সবচেয়ে সাধারণ ব্যবহার হচ্ছে রঞ্জক পদার্থ হিসাবে চুল, হাত ও পায়ের ডিজাইনে, উলকি (টাট্টু আর্ট) অংকণে। এছাড়াও মেহেদী পাতা নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। তাই মাথায় দেওয়া হয়। মাথা ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। একারণে অনেকেই মাথায় ব্যবহার করে। আবার বাজারে বিভিন্ন তেল হিসেবেও পাওয়া যায়। মাথায় কন্ডিশনার বা শ্যাম্পু হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
চামড়ায় যেকোন ক্ষত, পোড়া ও চামড়ার ফ্যাকাসে হলুদ দাগের নিরাময়ে অত্যন্ত কার্যকরী ঔষধ হিসেবে মেহেদী গাছ ব্যবহার হয়। স্কেবিস, চর্মের চুলকানি জাতীয় ও নখের ফাটা রোধে মেহেদী পাতার পেস্ট ব্যবহার হয়। মেহেদী শরীর থেকে পানি হ্রাস প্রতিরোধ করে। মাথাব্যাথা, জ্বর ও ভিটামিন-বি এর ঘাটতি জনিত কারণে পায়ের পাতার জ্বালা-পোড়ার ক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা হৃাস করে স্বস্তিদান করতে পারে মেহেদী।
লিভারের বিভিন্ন জটিলতা এবং জন্ডিস চিকিৎসায় মেহেদী গাছের বাকল বা ছাল ব্যবহার করা যায়। ফুলের তেল পারফিউম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মা-খালা বা বোনেরা মেহেদি পাতা বাটে এবং পরিবারের সব সদস্য, বিশেষ করে মেয়েরা আনন্দঘন পরিবেশে একে অন্যকে বিভিন্ন নকশায় তাদের হাত, কখনো পা রাঙাতে সাহায্য করে। বর্তমানে প্রক্রিয়াজাত মেহেদি বাটা এবং মেহেদি সজ্জার ছাঁচ ও নকশা বাণিজ্যিকভাবে উৎপন্ন হয়।
সম্প্রতি পরীক্ষায় জানা যায়, শুধু রঙের জন্য নয়, হাত ও নখের স্বাস্থ্যের জন্যও মেহেদি উপকারী। এটি ব্যবহারে হাতের ত্বক মসৃণ হয়। নখের কোনে নখকুনি দেখা দিলে মেহেদির পাতা বাটা ভালো ফল দেয়। চুল উঠে যাওয়া কিংবা অকালে পেকে যাওয়া দূর করতেও মেহেদির জুড়ি নেই। পাতার রস সরিষার তেলের সঙ্গে মিশিয়ে ঘাড়ে মালিশ করলে ব্যথা কমে যায়। মাথার খুশকি দূর করতেও দারুণ কার্যকর। টাটকা মেহেদি পাতার রস পায়ের জ্বালা কমাতে সাহায্য করে। মেহেদির রস দিয়ে তৈরি তেল মুখে ও চামড়ায় মাখলে ত্বক টানটান হয়ে ওঠে। এটি রক্ত পরিষ্কারক হিসেবেও কাজ করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়া এই পাতার রস আমাশয় এবং উদরাময় নিরাময়েও বিশেষভাবে কাজ করে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. নাজিরুল ইসলাম বলেন, অর্নমেন্টালি ছাড়াও ভেষজগুণের উদ্ভিদ হিসেবে এটি ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা থাকলে দেশে বাণিজ্যিকভাবে মেহদি গাছের চাষ হতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং এর পরিচালক কৃষিবিদ দিলরুবা আখতার বলেন, এদেশের সর্বত্র কোন কোন বাড়ির আঙ্গিনায় মেহেদী গাছ দেখা যায়। পরিকল্পিতভাবে ফসল হিসেবে বা বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়না। এগাছের সঠিক কোন পরিংখ্যান, কর্মসূচি, গবেষণা ও স্ট্যাডি নেই।