জলবায়ু পরিবর্তনে জমির স্বাস্থ্য উর্বরতা জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে লবণাক্ততায় উপকূলের দুই লাখ কৃষক বাস্তুহারা হওয়ার শঙ্কা
মতিনুজ্জামান মিটু : জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের অসচেতনতার কারণে জমির স্বাস্থ্য ও উর্বরতার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। জনসংখ্যার চাপ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগোচ্ছে দেশ। টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনা ও বাংলাদেশের কৃষির চ্যালেঞ্জগুলো হলো-বন্যা, অসময়ে বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, পাহাড়ি ঢল, অম্ল ও ক্ষারীয় মাটি, উপকূলীয় অঞ্চল, জোয়ারভাটা, লবণাক্ততা, ভূমিক্ষয়, জনসংখ্যার চাপে প্রতিনিয়ত কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাওয়া ইত্যাদি।
এক সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে কৃষি তথ্য সার্ভিসের প্রধান তথ্য অফিসার ড. সুরজিত সাহা রায় জানান, মাটির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের উপকূলের প্রায় দুই লাখ কৃষক বাস্তুহারা হবেন। উপকূল অঞ্চলের মাটির লবণাক্ততা বেড়ে ধান চাষের অনুপযোগী হলে কৃষক এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন। বিশ^ব্যাংকের গবেষণার বরাতে তিনি আরও জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। ‘রিভার স্যালাইনিটি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাভিডেন্স ফ্রম কোস্টাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এ অঞ্চলের ১৯ জেলার ১৪৮টি থানার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততায় আক্রান্ত হবে ১০টি নদীর পানি।
নদীগুলো হলো- সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ; খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, কয়রা, পাইকগাছা; বাগেরহাট জেলার মংলা এবং পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলা। এসব থানায় এখন ১০ পিপিটি মাত্রার লবণাক্ততা বিরাজ করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে কোন কোন স্থানে তা ১৫ থেকে ২৫ মাত্রায় উন্নীত হতে পারে। এভাবে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষি ও জীববৈচিত্র্য। খাবার পানি, সেচের পানির সংকট দেখা দেবে। মারা যাবে স্বাদু পানির মাছ, চিংড়ি প্রজাতির বৈচিত্র্যে আসবে পরিবর্তন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে মৎস্যজীবীসহ সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা।
লবণাক্ততা ও কৃষি প্রসঙ্গে এ কৃষি কর্মকর্তা আরও জানান, বৈশি^ক উষ্ণতা ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চত বেড়ে যাওয়ায় উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে সমুদ্রের লবণ পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে এবং ভূগর্ভস্থ পানিতেও লবণাক্ততা বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে বাঁধ ভেঙে বা বাঁধ উপচিয়ে লবণ পানি কৃষি জমিতে ঢুকে পড়ে কৃষি জমির লবণাক্ততা বাড়িয়ে স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাহত করছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৮.৬ লাখ হেক্টর উপকূলীয় এলাকার মধ্যে প্রায় ১০.৫৬ লাখ হেক্টর এলাকা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততা কবলিত। ফলে রবি ও খরিফ-১ মৌসুমে ফসল চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে। ওই সময়ে নদীর পানির লবণাক্ততা ২৫ থেকে ৩০ ডিএস/মি পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়। খালে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুকনো মৌসুমে ফসল চাষের জন্য স্বাদু পানির সংকট দেখা দেয় এবং পাশাপাশি সেচ নিষ্কাশনে সমস্যা হওয়ায় মাটির ‘জো’ আসতে দেরি হয়। ফলে শুকনো মৌসুমে এ এলাকার অধিকাংশ জমি পতিত থাকে।
কোন কোন এলাকায় সীমিত আকারে তিল বা মুগডালের চাষ হয়। আবার দেরিতে পানি অপসারণের কারণে সময়মতো তিল বা ডালের বপন সম্ভব হয় না। দেরিতে তিল বা ডাল বপন করলে পাকার আগেই বর্ষার পানিতে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া লবণমুক্ত পানির অভাবে আমন ধানের পরে বোরো ধান চাষও সম্ভব হয়ে ওঠে না।
লবণাক্ত অঞ্চলের মাটি কর্দমাক্ত হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে মাটি শক্ত হয়ে যায়। ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে শক্ত মাটির অভেদ্য স্তর ভেঙে দিয়ে সেচ প্রয়োগ করলে মাটির উপরের স্তরের লবণ নিচের স্তরে জমা হয়। ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে শক্ত মাটির অভেদ্য স্তর ভেঙে দিয়ে সেচ প্রয়োগ করলে মাটির উপরের স্তরের লবণ নিচের স্তরে জমা হয়। কাদা মাটিতে বালু মিশিয়ে মাটির গঠন পরিবর্তন করে লবণাক্ততা কমানো যায়। পর্যাপ্ত সেচ ও মালচিং করে উপরের স্তর ভেঙে দিলে লবণাক্ততা হ্রাস পায়। জোয়ারের পানি প্রবেশে বাধা দেয়ার জন্য বাঁধগুলো উঁচু ও মজবুত করতে হবে। খালে ড্রেজিং করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে।
মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত ৩টি প্রযুক্তি যেমনÑ কলস সেচ পদ্ধতি, খামার পুকুর পদ্ধতি ও দুই স্তর মালচিং পদ্ধতির মাধ্যমে লবণাক্ত জমিতে ফসল আবাদ করা যায়। কলস সেচ প্রযুক্তি শুধু মাদা ফসল যেমন- কুমড়া, তরমুজ, উচ্ছে, ঝিঙা ইত্যাদির জন্য উপযোগী। সাধারণ আকারের মাটির কলসের নিচে ড্রিল মেশিন দিয়ে বল পয়েন্ট কলমের আকারে ছিদ্র করে ওই ছিদ্রে দেড়-দুই হাত পাট শক্ত করে প্রবেশ করাতে হবে। পাটযুক্ত কলসি মাদার মাঝখানে এমনভাবে বসাতে হবে যেন ছিদ্রগুলো ও পাটের আঁশ মাটির নিচে থাকে। কলসের চারপাশে ৩ থেকে ৪টি বীজ বপন করে কলসে পানি দিলে মাদা সবসময় ভেজা থাকবে, এতে লবণ উপরে উঠবে না। এভাবে ২.০ থেকে ২.৫ ডিএস/এম পর্যন্ত লবণাক্ততা কমিয়ে আনা যায়।
খামার-পুকুর প্রযুক্তিতে একটি জমির অপেক্ষাকৃত নিচু অংশে পাঁচ ভাগের একভাগ জমিতে মোটামুটি ৬ থেকে ৭ হাত গভীরভাবে ১টি পুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে। পুকুরের চারদিকে বাঁধ দিয়ে পানির আগমন ও নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাঁধের উচ্চতা দুই থেকে আড়াই হাত ও প্রস্থ তিন থেকে চার হাত হবে। ফলে পুকুরে মাছ চাষ করা যাবে এবং শুকনা মৌসুমে জমিতে সেচ দেয়া যাবে। জমির অতিরিক্ত পানি পুকুরে জমা হয়ে নিষ্কাশনে সুবিধা হবে।
দুই স্তর মালচিং পদ্ধতি স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব। কর্ষণ স্তরের নিচে ধানের খড় দিয়ে মালচ স্থাপন করতে হবে এবং উপরিভাগে সুষম সারমিশ্রিত মাটি দিতে হবে। এর উপরে সবজির চারা বা বীজ বপন বা রোপণ করে গাছপালার চারদিকে ধানের খড় দিয়ে মালচ স্থাপন করতে হবে। দুই স্তর মালচিং লবণের ঊর্ধ্বাভিমুখী আগমন প্রতিরোধ করে এবং উপরের স্তর গাছের শিকড় অঞ্চলের আর্দ্রতা সংরক্ষণ করে। এভাবে মাটির সার্বিক লবণাক্ততা কিছু অংশে কমে যায়।
দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকগণ লবণাক্ত ও সেচের পানির অভাবকে মোকাবিলা করেই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শস্য নিবিড়তায় পিছিয়ে থাকা অঞ্চলটি যেন নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। এসব এলাকার কৃষকরা লবণাক্ততা সহনশীল উচ্চফলনশীল ধান, গম, ভুট্টা, সূর্যমুখী, আলু, রসুন চাষ করছে। ঘেরে অসময়ে তরমুজ, শিমসহ বিভিন্ন সবজি আবাদ করছে। ভাসমান বেডে সবজি উৎপাদন ও সর্জন পদ্ধতিতে আমড়া, পেয়ারাসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করছে। গ্রীষ্মকালীন টমেটো আবাদ করে কৃষকরা অধিক লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশ কয়েকটি লবণাক্ততা সহনশীল ধানের জাত আবিষ্কার করেছে। এসব জাত দক্ষিণাঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
ব্রি ধান৬৭ জাতটি বোরো মৌসুমে ৮-১০ ডিএস/এম লবণাক্ততা সহ্য করে হেক্টরপ্রতি ৭ টন ফলন দিতে সক্ষম। ব্রি ধান৯৭ ও ব্রি ধান৯৯ ১৪ থেকে ১৫ ডিএস/এম লবণাক্ততায় ভালো ফলন দিতে সক্ষম। এ ছাড়া বিনাধান-৮ ও বিনাধান-১০ বেশ আগে থেকেই দক্ষিণাঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় জাত।
লবণাক্ততা সহনশীল জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চমূল্য ফসলের আবাদ বৃদ্ধি, খাল খনন, বাঁধ নির্মাণ, উন্নত সেচ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের তথা লবণাক্ত এলাকার কৃষি অনেকটাই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করেন এ কৃষি তথ্য কর্মকর্তা।