ঢাকার ৯৫ ও দূরপাল্লার ৭০ শতাংশ গ্যাসচালিত হলেও শতভাগ গণপরিবহণে বর্ধিত ভাড়া
সোহেল রহমান : ঢাকার অভ্যন্তরে চলাচলকারী গণপরিবহণের ৯৫ শতাংশ এবং ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বা ঢাকার বাইরে চলাচলকারী গণপরিবহণের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ গ্যাসচালিত হলেও সারাদেশের প্রায় শতভাগ গণপরিবহণে বর্ধিত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ডিজেল ছাড়া শুধু গ্যাস চালিত পরিবহন-ই নয়, অকটেন ও পেট্রোল চালিত যানবাহনেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে আদায় করা হচ্ছে পুনঃনির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও বেশি। অন্যদিকে ভাড়া বাড়ানোর নতুন তালিকা বা চার্ট প্রতিটি বাস ও মিনিবাসে প্রকাশ্য স্থানে টানানো বা সাটানো বাধ্যতামূলক তা মানা হচ্ছে না। ভাড়ার তালিকা ছোট অক্ষরে লিখে গাড়ির এমন জায়গায় সাটানো হয় যা সচরাচর যাত্রীদের দৃষ্টিগোচর হয় না।
অতি সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য পুনঃনির্ধারণের পর পরিবহন খাতে ভাড়া বৃদ্ধিজনিত সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক গণপরিবহণে সরকার কর্তৃক পুনঃনির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করা না গেলে দেশের পরিবহন খাতে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাবে এবং এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে- এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বিআরটিএ’র প্রজ্ঞাপনে শুধু ডিজেল চালিত পরিবহনের ক্ষেত্রে ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা হয় এবং গ্যাস, অকটেন ও পেট্রোল চালিত পরিবহনের ক্ষেত্রে ভাড়া না-বাড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে প্রায় সকল ধরনের (ডিজেল, গ্যাস, পেট্রোল ও অকটেন) পরিবহনেই ভাড়া বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং যাত্রীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়ারও অতিরিক্ত আদায় করার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহন মালিকদের নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও ভাড়া আদায়ে স্বেচ্ছাচারিতা প্রদর্শনের ফলে যাত্রীদের সঙ্গে প্রায়শ:ই বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়ছে। যাতায়াত ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মানুষের জীবন-যাত্রায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশে মোট বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৭৮ হাজার। এর মধ্যে গ্যাস চালিত পরিবহনের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৮০০ (৬০%) ও ডিজেল চালিত পরিবহনের সংখ্যা ৩১ হাজার ২০০ (৪০%)। ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ১৬ হাজার। এর মধ্যে গ্যাস চালিত পরিবহনের সংখ্যা ১১ হাজার ২০০ (৭০%) ও ডিজেল চালিত পরিবহনের সংখ্যা ৪ হাজার ৮০০ (৩০%)। আর ঢাকার অভ্যন্তরে চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ১২ হাজার ৫২৬টি। এর মধ্যে গ্যাস চালিত পরিবহনের সংখ্যা ১১ হাজার ৯০০টি (৯৫%) ও ডিজেল চালিত পরিবহনের সংখ্যা ৬২৬টি (৫%)।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে ডিজেল চালিত অনেক বাস ও মিনিবাস সিএনজি ও এলপিজি-তে রূপান্তর করা হয়েছে। তবে সেগুলোতে জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ও গ্যাস উভয়ই ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। ভাড়া বাড়ানোর সুযোগে ঢাকার অভ্যন্তরে অধিকাংশ গ্যাস চালিত বাস ও মিনিবাস ডিজেল চালিত বলে দাবি করে বর্ধিত ভাড়া আদায় করছে।
প্রতিবেদনে ঢাকা মহানগর ও ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় প্রকৃত ভাড়া এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের চিত্র তুলে ধরে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণ সম্পর্কে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীর অধিকাংশ বাস ও মিনিবাস মালিক কর্তৃক ড্রাইভার-কন্ট্রাক্টরদের কাছে দৈনিক নির্ধারিত জমা বা লিজ ভিত্তিতে বাস ভাড়া দেয়া হয়। মালিকদের দৈনিক জমা বা লিজের টাকা; রাস্তায় বিভিন্ন পয়েন্টে প্রদত্ত চাঁদা এবং চালক-কন্ট্রাক্টর-হেলপারদের নিজেদের দৈনিক আয় তুলতে গিয়েই মূলত: যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্তে ভাড়া আদায়ের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে মালিক সমিতি ও সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়মিত মাসোহারা প্রদানে পরিবহন মালিকদেরও আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হয়। পরিবহন খাতের এ দুরবস্থা শুধু ঢাকা মহানগরীতেই নয়, দেশের প্রায় সকল মহানগর ও জেলাতেও বিদ্যমান।
এমতাবস্থায় গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধিজনিত সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দশ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ডিজেল ও গ্যাস চালিত পরিবহন বিআরটিএ কর্তৃক শনাক্ত করে স্টিকার সাটিয়ে দেয়া; পরিহনে ভাড়ার তালিকা বড় ও স্পষ্ট অক্ষরে লিখে প্রকাশ্য স্থানে টানিয়ে রাখা; অতিরিক্ত ভাড়া আদায় মনিটরিং-এ ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা; ডিজেল চালিত হিসেবে রেজিস্ট্রেশনকৃত যেসব বাস-মিনিবাস পরবর্তীতে সিএনজি/এলএনজি-তে রূপান্তরিত করা হয়েছে সেগুলো অনুমোদনহীনভাবে পুনরায় ডিজেলে চালানো হচ্ছে কি নাÑ তা মনিটর করা; পরিবহন মালিকদের দৈনিক জমা বা লিজ হিসেবে টাকা প্রদানÑ এ ধরনের প্রথা বাতিল করে মালিক কর্তৃক চালক, কন্ট্রাক্টর ও হেলপারদের দৈনিক পারিশ্রমিক প্রদান বা আয়-ব্যয়ের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গণপরিবহন চালানোর উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি।