বিবিসির ‘১০০ প্রভাবশালী নারী’র তালিকায় ৪৬ আফগান নারী
অর্থনীতি ডেস্ক : এ বছরের তালিকায় রয়েছেন সর্বকনিষ্ঠ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই, সামোয়ার প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ফিয়ামে নাওমি মাতাফা, ভ্যাকসিন কনফিডেন্স প্রকল্পের প্রধান অধ্যাপক হেইডি জে লারসন এবং প্রশংসিত লেখক চিমামান্দা আদিচি।
প্রতি বছরের মতো এবারও ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী এবং প্রভাবশালী নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে বিবিসি। এ তালিকায় অর্ধেক জায়গা জুড়ে রয়েছেন আফগান নারীরা। এবারই প্রথম কোনো দেশের এত সংখ্যক নারী এ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন।
সমাজ, সংস্কৃতি এবং বিশ্বকে নতুন করে উদ্ভাবনে ভূমিকা পালনকারী নারীদের নিয়ে প্রতিবছর এ তালিকা তৈরি করে বিবিসি। এ বছরের তালিকায় রয়েছেন সর্বকনিষ্ঠ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই, সামোয়ার প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ফিয়ামে নাওমি মাতাফা, ভ্যাকসিন কনফিডেন্স প্রকল্পের প্রধান অধ্যাপক হেইডি জে লারসন এবং প্রশংসিত লেখক চিমামান্দা আদিচি।
আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশটিতে নারীদের অবস্থান ছিল শোচনীয়। শিক্ষার সুযোগ থেকে শুরু করে চাকরি এবং নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগও ছিলোনা তাদের। তবে এসব বাধা-বিপত্তির পরেও থেমে থাকেননি এই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশটির নারীরা। ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৮ সালের মধ্যে আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার হার পৌঁছে ৩০ শতাংশে।
বিবিসির এ তালিকায় মোট ৪৬ জন আফগান নারীর মধ্যে স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে রয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীও।
বিবিসির ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর তালিকায় প্রথমেই রয়েছেন পুরষ্কারজয়ী কবি এবং লেখক লিমা আফশিদ। তার বেশিরভাগ লেখাতেই আফগান সংস্কৃতির পিতৃতান্ত্রিক নিয়মের বিষয়টির ফুটে ওঠে।৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে একজন স্বাধীন রিপোর্টার এবং সামাজিক ভাষ্যকার হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
পাশাপাশি শের-ই-দানেশগাহ কবিতা সমিতিরও একজন সদস্য তিনি। মহামারি চলাকালীন সময়ে ভার্চুয়াল কবিতা সেশনের আয়োজন করে এই সমিতি।
আফগানিস্তানের শান্তি মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার ও নাগরিক সমাজের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন দর্শন ও সামাজিক বিজ্ঞানে বিশিষ্ট ব্যক্তি ড. আলেমা। এছাড়াও তিনি স্বাধীন নারী রাজনৈতিক অংশগ্রহণ কমিটির প্রতিষ্ঠাতা এবং নারী-অধিকার বিষয়ক একজন আইনজীবী। জার্মানি থেকে দর্শনে পিএইচডিসহ সংঘাত বিশ্লেষণে ২০ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
তিনি জার্মান-আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আফগানিস্তানে নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে বই লিখেছেন। এছাড়া শরণার্থী, অভিবাসী এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের বিষয়ে মানবিক আইনের একজন পেশাদার প্রশিক্ষক এবং মডারেটরও তিনি।
মোমেনা কারবালায়ী নামে পরিচিত মোমেনা ইব্রাহিমী পুলিশ বাহিনীতে যোগদানের তিন বছর পর নিজেরই উর্ধ্বতনস্থ কর্মকর্তার দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হন। সেসময় তিনি এই ঘটনার প্রতিবাদের পাশাপাশি আফগান পুলিশ বাহিনীতে অপব্যবহারের অন্যান্য অভিযোগ সম্পর্কেও কথা বলেন।
অনিয়ম ও অপব্যবহার বিষয়ে কথা বলায় বরাবরই হুমকির শিকার হয়েছেন তিনি। তা সত্ত্বেও, তিনি নিজের এবং ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার অন্যদের ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করে গেছেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, “আমি এটা বিশ্বাস করতাম যে নির্যাতনের বিষয়ে অন্তত কারও কথা বলা উচিত এবং আমি ভেবেছিলাম জীবনের ঝুঁকি থাকলেও আমিই সেই ব্যক্তিটি হতে পারি।” গত আগস্টে তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর যুক্তরাজ্যে চলে যাওয়া হাজারো আফগানের মধ্যে তিনিও একজন।
হেরাত টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষক এবং একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আমেনা করিমিয়ান আফগানিস্তানে জ্যোতির্বিদ্যার উন্নয়নে মনোনিবেশকারী প্রথম নারীদের মধ্যে একজন।
২০১৮ সালে চালু হওয়া কায়হানা অ্যাস্ট্রোনমিকাল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী এবং প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তরুণদেরকে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে জানতে উৎসাহিত করে তার প্রতিষ্ঠান। চলতি বছরের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ্যা এবং জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা প্রতিযোগিতায় বিশ্ব জ্যোতির্বিদ্যা ইউনিয়ন থেকে একটি পুরস্কার জিতেছে করিমিয়ান এবং তার দল।
আফগানিস্তানের প্রথম নারী বাণিজ্যিক এয়ারলাইন পাইলট হিসাবে চলতি বছর যোগ দেন মোহাদিস মির্জাই। একজন নারী ক্রুসহ ঐতিহাসিক বোয়িং ৭৩৭ বিমান উড্ডয়ন করেন তিনি। -এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন।
তালেবানরা যখন কাবুলে প্রবেশ করে তখন বিমানবন্দরে থাকা মির্জাই একটি ফ্লাইট উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু, পরবর্তীতে নিজেই যাত্রী হিসেবে অন্য একটি বিমানে চড়েন। মির্জাই বলেন, তিনি ‘এমন একটি সমাজের পক্ষে যেখানে নারী ও পুরুষ একসাথে কাজ করতে পারে।’
২০১৯ সালে শখের বশে পর্বতারোহণ শুরু করেন ফাতিমা। এরপরই পর্বতারোহণের প্রতি আফগান মেয়েদের আগ্রহকে উৎসাহিত করাকে নিজের মিশন হিসেবে বেছে নেন তিনি। মাত্র ১৮ বছর বয়সে আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ নোশাখ (৭ হাজার ৪৯২ মিটার) চূড়ায় আরোহণকারী সর্বকনিষ্ঠ নারী হিসেবে নিজের নাম লেখান তিনি।
পর্বতারোহী হওয়ার পাশাপাশি সুলতানী গত সাত বছর ধরে বক্সিং, তায়কোয়ান্দো এবং জিউ-জিৎসু জাতীয় দলের সদস্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৬ বছর নির্বাসিত থাকার পর মাহবুবা সিরাজ ২০০৩ সালে নিজের জন্মস্থান আফগানিস্তানে ফিরে আসেন। তারপর থেকে তিনি নারী ও শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেশ কয়েকটি সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠায় ও নেতৃত্বে কাজ করেছেন।
তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেছেন মূলত গৃহস্থালিতে সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন, শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। চলতি বছর টাইম ম্যাগাজিনের ‘১০০ জন প্রভাবশালী নারী’র তালিকায়ও রয়েছেন তিনি।
জাতীয় হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দলের অধিনায়ক এবং প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য একজন বিশিষ্ট উকিল নিলোফার বায়াত। বর্তমানে তিনি রয়েছেন দেশের বাইরে। তিনি এবং তার স্বামী উভয়েই আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের জন্য কাজ করেছেন।
মাত্র দুই বছর বয়সে চলাফেরার শক্তি হারান তিনি। তাদের বাড়িতে একটি রকেট হামলা চালানোর পর মেরুদ-ের ব্যাপক ক্ষতি হয় তার। বায়াত তার বাস্কেটবলের প্রথম খেলাটি কাবুলের একটি খোলা কোর্টে খেলেছিলেন। আফগানিস্তানের নারী ক্রীড়াবিদদের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল তা। আফগান নারীদের জন্য একটি সমিতি স্থাপন করেছেন তিনি।
একজন প্রাক্তন সংসদ সদস্য এবং যোগ্যতাসম্পন্ন গাইনোকোলজিস্ট, ড. রোশনক ওয়ার্দাক ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে নারীদের চিকিৎসা করে আসছেন। এমনকি নব্বইয়ের দশকে তালেবান প্রথমবার ক্ষমতায় থাকার সময় নিজ প্রদেশের একমাত্র নারী ডাক্তার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
২০০১ সালে তালেবান পতনের পর তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি তিনি স্কুল পুনরায় চালু করার চেষ্টায় রয়েছেন। তালেবান নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করায় নারী-শিক্ষার জন্য একজন স্পষ্টবাদী উকিল হয়ে উঠেছেন তিনি।
আফগানিস্তানের নারীরা ছাড়াও বিবিসির এ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন পাকিস্তানের ৩, ইরানের ৪ এবং ভারতের একজন নারী। সূত্র : বিবিসি