করোনায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ৪৮ শতাংশ পরিবার ঋণগ্রস্ত
অর্থনীতি ডেস্ক : করোনার ধাক্কায় টিকে থাকতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪৮ শতাংশ পরিবারকে ঋণ নিতে হয়েছে। এসব পরিবার গড়ে ৫২ হাজার ৫৩৩ টাকা ঋণ নিয়েছে। এখন সেই ঋণের জালে চার থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত আটকে থাকতে হবে তাদের। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত দুই দিনব্যাপী এক সম্মেলনের প্রথম দিনে রোববারের একটি অধিবেশনের মূল প্রবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ইশতিয়াক বারি বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অতিমারি মোকাবিলা ও খানা জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন। সারা দেশের চর, হাওর, উপকূলীয় অঞ্চল এবং দলিত, আদিবাসীসহ পিছিয়ে পড়া ১ হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর এই জরিপ করা হয়। ঢাকায় মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে মহামারি থেকে উত্তরণের পথে বাংলাদেশ : অভিজ্ঞতা অর্জন ও নীতি প্রণয়ন শীর্ষক দুই দিনের এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
জরিপের ফলাফলে বলা হয়, করোনার মধ্যে ৭৮ শতাংশ পরিবার আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে। এর মানে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি পাঁচ পরিবারের চারটিই এমন সংকটে পড়েছে। তবে চর ও উপকূলীয় অঞ্চলে এই দুরবস্থা বেশি প্রকট। পরিবারগুলোর গড়ে ১৯ শতাংশ আয় কমেছে। করোনার প্রথম দিকে সরকারি ছুটি ঘোষণার কারণে ৭০ শতাংশ পরিবারের অন্তত একজন সদস্য কাজ হারিয়েছেন। অবশ্য পরে তাদের ৯৭ শতাংশ আবার কাজ ফিরে পেয়েছেন।
জরিপ মতে, সংসারের খরচ চালাতে সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ পরিবারকে। গড়ে তারা ৩৪ হাজার ৪৬২ টাকার সঞ্চয় ভেঙেছে, যা তাদের পাঁচ মাসের সঞ্চয়ের সমান। আর যাদের সঞ্চয় নেই, তারা ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে। এ ধরনের পরিবারের উপার্জনকারীরা প্রায় সবাই অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মী।
বিশেষ আলোচক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, করোনার সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিস্থিতি অনুসারে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তৈরি করতে পারেনি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেই চেষ্টা করেছে। বিবিএস ভবিষ্যতে কোনো এক সময় খানা আয় ও ব্যয় জরিপ করবে, তখন কোভিডের চিত্র উঠে আসবে, তা আশা করা যায় না। শিগগিরই এই বিষয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিবিএসের বসা উচিত।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ফলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খানও একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে আরেকটি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, সরকারের কাছে পর্যাপ্ত টাকা নেই। আগের মতো স্বস্তিদায়ক অবস্থা নেই। ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি বদলায়নি। যাঁরা প্রণোদনা ঋণ নিয়েছেন, তাঁরা সেই টাকা আর ফেরত দিতে না-ও পারেন। এতে কুঋণ বাড়বে।’ তিনি আরও বলেন, দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কর্মসূচি প্রয়োজন।
এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
এর আগে সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এতে তিনি কোভিডের কারণে বাংলাদেশে সাত ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। পরিস্থিতিগুলো হচ্ছে- নি¤œ মৃত্যুহার ও টিকাদানে পিছিয়ে পড়া, সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রভাব, শ্রমবাজারে অস্থিরতা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পতন, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য খাতে উদ্বেগ, শিক্ষা খাতের চ্যালেঞ্জ এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় নীতিসহায়তার কার্যকারিতা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, এখন বাঙালিদের উপোস থাকার খবর নেই। ভাতের অভাব থেকে মুক্তি পেয়েছি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সুনামগঞ্জের হাওরের লোকজনও কেউ উপোস থাকে না। সেখানে মুরগির দাম ছোট মাছের চেয়ে কম।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, তথ্য-উপাত্তের ক্ষেত্রে এ দেশে নৈরাজ্য আছে। তথ্য-উপাত্তের অভাবে করোনার মধ্যে কোন খাতে কী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা জানি না। তথ্য-উপাত্ত থাকলে নীতি প্রণয়ন সহজ হয়।
অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু খরচ সারা বিশ্বে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম। এটি বাড়াতে হবে। কারণ, স্বাস্থ্যসেবা নিতে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা খরচ বেশি হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ প্রমুখ। সম্মেলনটি আয়োজনে সহায়তা করেছে সিপিডি।
সম্মেলনের শেষ দিনে আজ সোমবার একাধিক অধিবেশনে শ্রমবাজার, কর্মসংস্থান ও মহামারি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হবে।
দুপুরের পর অপর কর্ম অধিবেশনে বলা হয়, অতিমারির কারণে দারিদ্র্য বেড়েছে। আর তাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নারীরা। অব্যবস্থাপনার কারণে করোনাকালে দরিদ্র মানুষকে দেওয়া সরকারি প্রণোদনার অর্থ অনেকের হাতে পৌঁছায়নি। এ-সংক্রান্ত এক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে অনুষ্ঠানে বলা হয়, মাঠপর্যায়ের এক জরিপে দেখা গেছে, তালিকাভুক্ত ৮৫ শতাংশ মানুষ জানতেনই না, প্রণোদনা না পেলে অভিযোগ করার সুযোগ আছে। ৬০ শতাংশ মানুষ প্রণোদনার কিছুই পাননি। আবার প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে গ্রামের তুলনায় শহরেই বেশি সহায়তা পৌঁছেছে।