মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশকেই সমর্থন দেবে ভারত : রাষ্ট্রপতি কোবিন্দ
অর্থনীতি ডেস্ক : ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে- এমন একটি বাংলাদেশকেই তার দেশ সমর্থন দিয়ে যাবে এবং এ বিষয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে দিল্লি ফেরার আগে শুক্রবার ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
বাংলাদেশে প্রবাসী ভারতীয় এবং ঢাকায় ভারতীয় বন্ধুদের জন্য আয়োজিত এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রাম নাথ কোবিন্দ বলেন, বাংলাদেশে আমাদের বন্ধুদের আমি আবারও আশ্বস্ত করছি, ভারত আপনাদের অসাধারণ আন্তরিকতা এবং বন্ধুত্বকে মূল্যায়ন করে। আমরা ঘনিষ্ঠভাবে আপনাদের সাথে যুক্ত থাকতে চাই; উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যৌথ সমৃদ্ধি অর্জন এবং আমাদের জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চাই।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত বুধবার ঢাকায় পৌঁছান রাষ্ট্রপতি কোবিন্দ। সেদিনই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বৈঠক হয়।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কোবিন্দ বলেন, বাংলাদেশের যে মূল চেতনা, একটি প্রগতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক ও সম্প্রীতির সমাজ গড়ে তোলা, সেই মূল্যবোধকে এগিয়ে নেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছি, ভারত এমন একটি বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে যাবে, যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে।
ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের ৫০ বছর পূর্তির এই বছরে ঢাকায় আসতে পেরে নিজের আনন্দের কথা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রকাশ করেন ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের উষ্ণ ভালবাসা তার হৃদয় ছুঁয়েছে। গত বছর কোভিড-১৯ মহামারী শুরুর পর এটাই আমার প্রথম বিদেশ সফর। আর বাংলাদেশে আমার প্রথম সফর হল এমন এক বছর, যখন আমরা যৌথভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার এবং আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি।
স্বৈর শাসকের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করার জন্য এ দেশের মানুষ যে বিপুল ত্যাগ স্বীকার করেছে, সেজন্য শ্রদ্ধা জানান ভারতের রাষ্ট্রপতি। ভয়ঙ্কর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখে দাঁড়ানোর অদম্য সাহসের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে অভিনন্দন জানান।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করা বাংলাদেশি ও ভারতীয় শহীদদের স্মৃতির প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাম নাথ কোবিন্দ।
গত বুধবার ঢাকা পৌঁছেই সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে চলে যান ভারতের রাষ্ট্রপতি; সেখানে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে ধানম-িতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গিয়ে বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান।
সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কোবিন্দ বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের জনগণ যে নৃশংসতা ও গণহত্যার মুখোমুখি হয়েছিল এবং নৃশংস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রামের কথাগুলো আমার মনে পড়ছিল।
আজ যেমন আপনাদের দেশ এই অঞ্চলে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের মডেলে পরিণত হয়েছে, তেমনি বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের জনগণের লড়াই ন্যায্য ছিল। এ লড়াই ছিল মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল প্রকৃতপক্ষে পেশিশক্তিকে পরাজিত করে অধিকারের জয়।
রাষ্ট্রপতি কোবিন্দ বলেন, ভারতীয়দের হৃদয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। দুই দেশের মানুষে মানুষে রয়েছে বহু পুরনো আত্মীয়তা, রয়েছে ভাষা আর সংস্কৃতির প্রাচীন বন্ধন।
মুক্তিযুদ্ধের পর, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বড় ধরনের আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে। ভারতও এই সময়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমাদের দুই দেশের জনগণের মধ্যে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক যোগসূত্র তৈরি হয়েছে, তাও প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের এই যৌথ গল্পে ভূমিকা রেখেছে।
রাম নাথ কোবিন্দ বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিপথ যে পরস্পর সংযুক্ত, সম্পদ ও অভিজ্ঞতার বিনিময়ই যে টেকসই উন্নয়নের মূলমন্ত্র, দুই দেশের নেতৃত্বই তা জানে।
আমি এটা জেনে আনন্দিত যে, আমাদের এই যৌথ প্রবৃদ্ধিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব করতে উভয়পক্ষই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পরিবেশবান্ধব জ্বালানিও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও জোরদার করার বিরাট সম্ভাবনা দেখছি আমি।
ভারতের রাষ্ট্রপতি বলেন, এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সমন্বয়ের গুরুত্বের বিষয়ে তার দেশ সচেতন।
এই চেতনার আলোকে, একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হয়ে ওঠার যাত্রায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিয়ে যেতে, বৃহত্তর সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অংশীদার হতে ভারত অঙ্গীকারাবদ্ধ।
আমি দুই দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে, বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং আমাদের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মধ্যে আমাদের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক যোগাযোগকে নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগটি কাজে লাগাতে অনুরোধ জানাব।
ভারত ও বাংলাদেশ- দুই দেশই যে মোট জনসংখ্যায় তরুণ কর্মীবাহিনীর সংখ্যাধিক্যের সুবিধা ভোগ করছে, সে কথা তুলে ধরে এর সুফল কাজে লাগাতে আরও উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি কোবিন্দ।
তিনি বলেন, এই অনন্য বছরে, মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী, বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী এবং আমাদের বন্ধুত্বের ৫০তম বার্ষিকী এবং সেই সাথে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপন করার সময়ে, আসুন আমরা আমাদের জাতির স্থপতিদের স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজেদেরকে পুনরায় উৎসর্গ করি।
আমি আত্মবিশ্বাসী, ১৯৭১ সালে রক্ত ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া এ বন্ধন ভবিষ্যতেও আমাদের দুই দেশকে বেঁধে রাখবে।
এর আগে শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্ত্রী সবিতা কোবিন্দ ও মেয়ে স্বাতী কোবিন্দকে সঙ্গে নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছান ভারতের রাষ্ট্রপতি। সেখানে তাদের স্বাগত জানান ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান।
ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান কালী মন্দিরের সংস্কার হওয়া অংশের ফলক উন্মোচন করেন এবং পরে স্ত্রী ও মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে পূজা দেন দেবী প্রতিমার সামনে।
মূল মন্দিরে ঢোকার সময় শাঁখ বাজিয়ে সনাতনী রীতিতে অভিবাদন জানানো হয় ভারতের রাষ্ট্রপ্রতিকে। প্রার্থনা শেষে মন্দির প্রাঙ্গনে উপস্থিত মন্দির কমিটির সদস্য এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন কোবিন্দ। সব মিলয়ে ১৫ মিনিটের মত রমনা কালী মন্দিরে ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ধ্বংস হয় প্রাচীন এ মন্দির। মন্দির ও আশ্রমে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মন্দিরের সেবায়তসহ প্রায় একশ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সাধারণ মানুষ নিহত হন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংস করা অংশটি ভারত সরকারের সাত কোটি টাকা অনুদানে সংস্কার করা হয়েছে। ভক্তনিবাস ও মূল মন্দিরও পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। শুক্রবার সেই অংশেরই উদ্বোধন করলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। সূত্র : বিডিনিউজ, বাংলানিউজ, টিবিএস বাংলা অনলাইন, নিউজবাংলা