বাজার ব্যবস্থাপনায় অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের নিত্যপণ্যের চড়া মূল্যে থেমে থেমে চলে জীবন-সংসার
ভূঁইয়া আশিক রহমান : লুৎফর রহমান সরকার, একজন চাকরিজীবী। ঢাকায় থাকেন। বিদেশি একটি সিগারেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। সকাল আটটায় কাজের উদ্দেশে বের হন, ফিরেন রাত এগারোটার পর। মাসিক বেতন হিসেবে যে টাকা পান, তা দিয়ে চার সদস্যের সংসার চলে না। প্রতি মাসেই ধারকর্জ করে চলতে হয়। দুই মেয়ের একজন অনার্সে পড়ে, অপরজন দশম শ্রেণিতে। তাদের পড়ালেখা ও ভরণপোষণ করতে গিয়ে রীতিমতো ক্লান্ত। লুৎফর রহমান বলেন, জীবন আর চলে না। কীভাবে চলবে বলুন যদি এককেজি মোটা চালের মূল্য ৫০ টাকা বা তারও বেশি হয়। যে মুলা মানুষ খেতে চায় না বললেই চলে, সেই মুলার দামও চল্লিশ টাকা কেজি! তেলের দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে সেই কবে। কিছুদিন পরপর নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। বেতনের টাকা সাত দিনেই শেষ হয়ে যায়, পুরো মাস ধার করে চলি। এভাবে আর কতো।
প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কামরুল হাসান ও গার্মেন্টসকর্মী সালেহা বেগম। তাদের মতে, জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে নিত্যপণ্যের দাম চড়া থাকলেও পরে নিত্যপণ্যের বাজারে রীতিমতো ‘আগুন’ লেগেছে। চাল, ডাল, তেল, নুন, শাকসবজির বাজারে যাওয়া যায় না। পণ্যমূল্যের আগুনের উত্তাপে গায়ে রীতিমতো ফোসকা পড়ার যোগাড়! সরকার কি তা দেখে না?
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, যে সমস্ত উপাদান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে সেসব উপাদান যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকে তাহলে সেটা করা উচিত। কারণ তা না হলে সকলকেই আঘাত করে। তেলের দাম কোন সময় বৃদ্ধি করা দরকার, তা সমন্বয় করা দরকার ছিলো। তেলের মূল্য বাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কিনা তা আগে থেকে ভাবা প্রয়োজন ছিলো। তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে যে ব্যয় বাড়বে, ভর্তুকির উপযোগিতা কতোÑ তা স্টাডি করে সমন্বয় করা প্রয়োজন ছিলো। প্রতিটি কাজের উদ্দেশ্য থাকে। হোমওয়ার্কও নিশ্চয়ই ছিলো বা আছে। হোমওয়ার্কে ইপ্সিত লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো কি? কারণ তেলের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব ঠিকই পড়েছে অর্থনীতিতে। জনজীবনে। জীবন নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের পক্ষে।
পঞ্চাশ বছর এমনি এমনি অর্থনীতি বড় হয়ে উঠেনি। অনেক চড়াই-উৎড়াই পাড়ি দিয়েই আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে। বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টদের অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগছে না মাঝেমধ্যে অথবা অভিজ্ঞতা কাজে লাগনোর ব্যাপারটি বেমালুম ভুলে যাওয়া হচ্ছে। দ্রব্যের মূল বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতির ওপর তার কী প্রভাব পড়ে, কয়েকবার ঠেকেও শেখা হয়নি।
ক্যাবের জ¦ালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, দেশের উন্নয়নের সুবিধা, বণ্টনের ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত হয়নি। জিডিপি বা দেশের আয় যে উৎপাদন থেকে বা জাতীয় সক্ষমতা খাতটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেখানে জ¦ালানি জাস্টিসটা উপেক্ষিত থেকে গেছে। জ¦ালানি তেলের ব্যয়বৃদ্ধি অযৌক্তিক। জ¦ালানি তেল ক্রয়ের ক্ষেত্রে মানুষ লুণ্ঠনের শিকার হচ্ছে ন্যায্য মূল্যের পরিবর্তে। যৌক্তিক ও ন্যায্য মূল্যহার নির্ধারণে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। জ¦ালানি খাতের লুণ্ঠনমূলক ব্যয় মুক্ত করে এনার্জি জাস্টিস নিশ্চিত করা জরুরি। গ্যাস, তেল, এলএমজি, এলএনজি’র বেশি ব্যয় দেখিয়ে বেশি মূল্য নেওয়া হচ্ছে। জ¦ালানি তেলই শুধু নয়, সবক্ষেত্রেই একইকথা প্রযোজ্য।
বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। মাথাপিছু আয়ের যে হিসাব দেওয়া হয়, তাতে পাঁচজনের পরিবারের মাথাপিছু আয় দেখানো হয় ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু ১০ কোটি মানুষের জীবনে এই হিসাব মেলানো যাবে না। অতিউচ্চ ধনী বা যারা শতকোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছেন আর সাড়ে সাতকোটি মানুষের একাউন্টে গড়ে ৬-৭শ টাকা। হাজার হাজার কোটি টাকার মালিকদের টাকা গড় করে সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দিলে সেটা জনগণের উন্নতি বোঝায় না।
দেশে সাদা অর্থনীতির চেয়ে কালো অর্থনীতি অনেক বড়। ফলে ৬ লাখ কোটি টাকার বাজেট যখন হয় তারচেয়ে বেশি পরিমাণ টাকা একটা গোষ্ঠীর হাতে জমা হয়। এর পেছনে মূল কারণ কৃত্রিম বাজার সংকট সৃষ্টি করা এবং নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া। চালের ৫ টাকা দাম বাড়িয়ে দিলেই ১৫ হাজার কোটি টাকা কিছু লোকের হাতে জমা হয়। এভাবে তেল, আলু, মরিচ, ডাল, ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন বাজেটের চেয়ে বেশি টাকা জনগণের পকেট থেকে চলে যায়। সাধারণ খুচরা ব্যবসায়ী সামান্য অংশই পায়, মূল টাকা একটা গোষ্ঠীর হাতে জমে।
বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের ওপর একটা অর্থনৈতিক ভার-বোঝা চাপিয়ে দিয়ে লুটপাটের অর্থে অদৃশ্য কালো টাকার বিশাল পাহাড় তৈরি হয়। বিদেশে পাচার হয়। এই টাকায় কোথাও বেগম পাড়া তৈরি হয়, সুইস ব্যাংকে জমা হয়। প্রবাসী, গার্মেন্টস শ্রমিক ও কৃষকরা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। অথচ তাদেরই নিত্যপণ্যের আগুনে পুড়তে হয়।