বিজয়ের ৫০ বছর স্বাস্থ্যসেবায় সফলতা অনেক অপ্রাপ্তিও কম নয়
শিমুল মাহমুদ : বিজয়ের ৫০ বছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে ২৬ বছর। বর্তমানে দেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭২ বছর ৮ মাস। পক্ষান্তরে ১৯৭১ সালে গড় আয়ু ছিলো ৪৬ বছর ৭ মাস। এ হিসেবে বিশে^র অন্যান্য দেশের মানুষের গড় আয়ুর বৃদ্ধির তুলনায় গড় আয়ু বৃদ্ধি প্রায় দ্বিগুন। যা প্রতিনিধিত্ব করে সমগ্র স্বাস্থ্যসেবাকে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গড় আয়ু বৃদ্ধি, মা ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক, পোলিও মুক্ত বাংলাদেশ, শিশু স্বাস্থ্য পরিসেবা, হাসপাতালে আধুনিক যন্ত্রাংশ। সব মিলি এ উন্নতি ঈষনীয়।
তবে অপ্রাপ্তিও কম নয়। ১৯৭১ এ দেশে স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগই ছিল সরকারি। বর্তমানে দুই-তৃতীয়াংশই বেসরকারি। বিশেষ করে, প্রান্তিক পর্যায়ে এখনও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। মানসম্পন্ন ও দক্ষ জনবলের অভাব, দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক থাকলেও রয়েছে নার্স ও টেকনিশিয়ানের ঘাটতি।
স্বাধীনতার সময় শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১৪১, সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর প্রতিবেদন অনুযায়ি এখন তা ২১। অর্থাৎ, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে ৮৫ শতাংশ। ১৯৭২ সালে সারা দেশে হাসপাতাল ছিল মাত্র ৬৭টি। সব মিলিয়ে মাত্র সাত হাজারের মতো। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ৫১,৩১৬টি। আর বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৫,০৫৫টি, যেখানে মোট শয্যার সংখ্যা ৯০,৫৮৭টি। তখন ডাক্তার প্রতি রোগী ছিলো নয় হাজার, বর্তমানে ডাক্তার প্রতি রোগী ৬৫৭৯ জন।
১৯৭১ সালে ৩ লাখ মানুষের জন্য তখন ছিলো একটি করে হেলথ কমপ্লেক্স। বর্তমানে এখন প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, বস্তি, ভাসমান, চর ও হাওড়াঞ্চলের মানুষ এখনও স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেনা। দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ এখনও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণায় ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়েও সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে চিকিৎসা পেতে যে পরিমাণ অর্থব্যয় হয় এর ৬৭ শতাংশই রোগীকে বহন করতে হচ্ছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের জন্য মানসম্পন্ন ও দক্ষ জনবলও দরকার। দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক থাকলেও নার্স ও টেকনিশিয়ানের ঘাটতি আছে।সুতরাং সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা দূরেই আছি।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে রণাঙ্গনে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাতা ও ১৯৮২ সালে প্রবর্তিত বাংলাদেশের ‘জাতীয় ঔষধ নীতি’ ঘোষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
তার মতে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে স্বাস্থ্য খাতে প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির পাল্লাই ভারী। সরকারি কর্মকর্তা, ঠিকাদার এবং ওষুধ কোম্পানিগুলো মিলেমিশে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হওয়ায় এত বছরেও স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, গ্রামে গ্রামে আমাদের বিল্ডিং আছে কিন্তু চিকিৎসক নেই। দেশের মানুষ পরিপূর্ণ পুষ্টি পায় না। চিকিৎসাসেবা পায় না। একটি ইউনিয়নে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের বাস থাকলেও একজন এমবিবিএস পাস চিকিৎসক দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এটা লজ্জার ব্যাপার।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবায় মোট খরচের ৬০-৭০ ভাগ যায় মানুষের পকেট থেকে। সবার পক্ষে শহরে আসা সম্ভব নয়। সংবিধান স্বীকৃত স্বাস্থ্যসেবার অধিকার পাচ্ছে না সব মানুষ। এটা সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা সরকারের। চিকিৎসকদের নিজ নিজ জেলা থেকে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নিজ জেলায় যারা চাইবে পরীক্ষায় অংশ নেবে, আর যারা চাইবে না তারা অংশ নেবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, বর্তমানে বিনামূল্যে ৩০ রকমের ওষুধ সরবরাহ করা হয়। ঘরে ঘরে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে ৪৩ টি হাসপাতালে টেলি-মেডিসিন সার্ভিস চালু রয়েছে। মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ৩০ হাজার স্যাটেলাইট ক্লিনিক রয়েছে। অটিজম আক্রান্ত ৫ লাখ শিশুকে বিনামূল্যে সেবা প্রদানের জন্য ১০৩ টি সেবা কেন্দ্র রয়েছে।
দেশে নিবন্ধিত চিকিৎসক রয়েছেন ১ লাখ ২ হাজার ৯৯৭ জন। এর মধ্যে ৭৫ হাজার ৫৮৮ জনই কাজ করছেন বেসরকারি পর্যায়ে।
সরকারি পর্যায়ে বর্তমানে নার্সের সংখ্যা মাত্র ১৪ হাজার ৬৮৬। আর বেসরকারি পর্যায়ে নার্স রয়েছেন এর চার গুণেরও বেশি, ৫৮ হাজার ৩৫৭।