দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে বহুমাত্রিক ফসল ঢেমশি
মতিনুজ্জামান মিটু : ঢেমশি নতুন নয় ঐতিহ্যবাহী বহুমাত্রিক ফসল। নামটি নতুন মনে হলেও এটি কিন্তু এদেশের ঐতিহ্যবাহী আদি ফসলের মধ্যে একটি। বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মু. আব্দুস ছালাম জানান, এটি শুধু খাদ্য নয় অনেক রোগের মহৌষধ হিসেবে কাজ করে ম্যাগনেটের মতো। এক সময় এটির জনপ্রিয়তা গ্রহণযোগ্যতা অনেক ছিল। কালের ঢামাঢোলের মাঝে হারিয়ে যেতে বসেছিল। আবার কিছু মানুষের আন্তরিকতা প্রচেষ্টায় এবং ঢেমশির বৈশিষ্ট্যের কারণে আবারও আস্তে আস্তে জায়গা করে নিচ্ছে কৃষি ভুবনে।
ঢেমশি আদি শীতকালের ফসল। ঢেমশির ইরেজি নাম বাকহুইট। যদিও গমের নামের সঙ্গে মিল আছে কিন্তু গম পরিবারের এটি নয়। উদ্ভিদতাত্ত্বিক দিক দিয়ে গমের সঙ্গে কোনো মিল নেই। বরং সরিষার সঙ্গে বেশ মিল আছে। ঢেমশি বীজ বপন থেকে পাকা পর্যন্ত সরিষার সঙ্গে মিল কাটার পর ধানের সঙ্গে বেশি মিল আছে। তাহলে মোটামুটিভাবে সরিষা ও ধান দুটো ফসলের বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে ঢেমশি ফসল। এটির আদিবাস বৃহত্তর রাশিয়ার ইউক্রেনে। কালক্রমে দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আবাদ হচ্ছে ব্যবহার হচ্ছে। বলা হয় পৃথিবীর ৫টি সেরা খাদ্যের মধ্যে ঢেমশি অন্যতম একটি। অথচ এদেশে এটি সবচেয়ে অবহেলিত ফসল। উন্নত দেশগুলোতে ঢেমশি খায় জ্ঞানী, বিজ্ঞ, বড়লোকরা। এদেশে খেত গরীব এবং তথাকথিত অশিক্ষিতরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, ৬০ এর দশকে শুরু হওয়া ঢেমশি ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এদেশের বিভিন্ন জেলায় চাষ হতো মোটামুটি পরিসরে। কিছু মানুষের অজ্ঞতা আর অবহেলার কারণে মহাউপকারী এবং গুরুত্বপূর্ণ এ ফসলটি হারিয়ে গেছে এবং প্রতিস্থাপিত হয়েছে জীবন ধ্বংসকারী আরও কত ফসল। বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন গুরুত্বপূর্ণ এ ফসলটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে এবং পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী জেলায় ইতোমধ্যে চাষ শুরু করেছে। আস্তে আস্তে চাষের এলাকা, আবাদ ফলন উৎপাদন বাড়ছে।
এটি একটি অলৌকিক ফসল। যাতে রয়েছে মানবদেহের জন্য অতিজরুরি অনেক পুষ্টি উপাদান। এতে রয়েছে ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, সবজি এবং ফলের প্রায় সব পুষ্টি উপাদান, এছাড়া রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ, অ্যামাইনো এসিড এবং ইলেকট্রলাইটস। এ ফসলটি চাষ করতে কোনো সার, পানি, বালাইনাশক এবং যতœ লাগে না। ১ কেজি ধান ফলাতে শুধু পানিই লাগে প্রায় ৪ হাজার লিটার। আর এ কারণেই বাংলাদেশের মাটির নিচের পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে এবং যাচ্ছে। আধুনিক উন্নত ফসল ফলাতে গিয়ে অযাচিতভাবে ক্ষতিকারক রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করে মাটি, পানি, বাতাস এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। আর এ কারণেই পুকুর, খালবিল, নদীনালায় মাছ কমে যাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে, লাখ লাখ মানুষ অহরহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট এবং সবচেয়ে দামি মধু এ ঢেমশির ফুল থেকেই উৎপাদন হয়। বিদেশের কোনো বাসায় বেড়াতে গেলে কেউ যখন ঢেমশির মধু নিয়ে যান তখন বাড়িওয়ালারা বেশ খুশি হন। ঢেমশি চাল, আটা, ছাতু, মধু এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে বছরে শত কোটি টাকার বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করা সম্ভব। অপর দিকে, অতি সহজে ঢেমশিই পারে এ দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য প্রতিষ্ঠা করতে। মাটি, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশের উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা যাবে খুব সহজেই যদি দেশে আবার অবহেলিত ফসল ঢেমশি চাষ করা হয়।
ঢেমশি স্বল্প জীবনকালসম্পন্ন একটি বিশেষ ফসল। অবহেলিত ফসলটি এদেশে ফসলের তালিকায় উল্লেখযোগ্য প্রধান ফসল হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারে শুধু এর বহুমাত্রিক যোগ্যতাও সাশ্রয়ী বৈশিষ্ট্যের জন্য। বছরের যে সময় জমি মোটামুটি পতিত থাকে বা ধান আবাদ করা যায় না সেসব জমিতে সে সময়ে সাথী বা মিশ্র ফসল হিসেবে সমন্বয় করতে পারে ঢেমশি। অন্যান্য ফসল যেখানে হয় না বা হতে সমস্যা সেখানে খুব অনায়াসে ঢেমশি ফলানো যায়। বীজ বপনের ৮০ থেকে ৯০ দিনের মধ্যেই ফসল কাটা যায়। উৎপাদন খরচ নেই বললেই চলে। কেননা কোনো রাসায়নিক সারের দরকার নেই। পোকামাকড়ের আক্রমণ হয় না বলে বালাইনাশকের খরচ থেকে পুরোপুরি বেঁচে যাওয়া যায়। সেচের তেমন প্রয়োজন নেই। চরাঞ্চলের মাটি এবং বেলে দোআঁশ মাটিতে ভালো হয়। আগাছা দমনের দরকার পড়ে না কেননা এরা নিজেরাই আগাছা নষ্ট করে দেয়। সাধারণভাবে জৈবসার ব্যবহার কওে কাংখিত ফলন পাওয়া যায়। বর্তমানে উত্তরবঙ্গে কয়েক হাজার একর জমিতে ঢেমশির আবাদ হচ্ছে। এটি দিন দিন আরো জনপ্রিয় হচ্ছে পরিধি পরিসর বাড়ছে।
ঢেমশি ঠিক ভাতের মতোই বরং পুষ্টিগুণ ভাতের চেয়ে অনেক বেশি। ঢেমশি খেলে যেসব উপকার পাওয়া যাবে তাহলো- কম পরিমাণ শর্করা এবং বেশি পরিমাণ ফাইবার থাকায় রক্তে সুগারের পরিমাণ (ডায়াবেটিস) নিয়ন্ত্রণ করে। হৃদরোগী এবং ডায়াবেটিস রোগীর জন্য একমাত্র আদর্শ এবং নিরাপদ খাদ্য। প্রাকৃতিকভাবেই অধিক পরিমাণ আমিষ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক সমৃদ্ধ বিভিন্ন খাদ্যোপাদান আছে বলে শিশুর ওজন, উচ্চতা, মেধাশক্তি, পেশি শক্তি, হিমোগ্লোবিন লেভেল বৃদ্ধি করে। বেশি পরিমাণ আমিষ থাকায় গর্ভবতী এবং দুগ্ধদানকারী মায়ের জন্য অতি জরুরি (শিশু প্রচুর দুধ পাবে)। বেশি পরিমাণ ফাইবার থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং মন ও দেহ সুস্থ সুন্দর থাকে। হাঁড়ের ক্ষয়রোধ করে, মজবুত করে এবং হাঁড়ের স্বাস্থ্যের গঠন উন্নয়ন করে বলেই শরীরে কোনো ব্যথা থাকে না। বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং নিরাময়ে সহায়তা করে। সব বয়সীদের অ্যাজমা হাড়ক্ষয় রোগ কমাতে সাহায্য করে, হাড় মজবুত করে। মেয়েলি রোগের একটি মহৌষধও বটে।
পুষ্টির দৃষ্টিকোণ থেকেও ঢেমশি বেশ মূল্যবান ফসল। এতে আছে- শক্তি ৩৪৩ কিলোক্যালরি; শর্করা ৫৫ শতাংশ; আমিষ ২৪ শতাংশ; টোটাল ফ্যাট ১৭ শতাংশ; কোলস্টেরল ০ মিলিগ্রাম; ডায়টেরি ফাইবার ২৬ শতাংশ; সোডিয়াম ১ গ্রাম, পটাসিয়াম ৪৬০ মিলিগ্রাম (১০ শতাংশ), ক্যালসিয়াম ১৮ মিলিগ্রাম (২ শতাংশ), কপার ১.১, লৌহ ২.২০ (২৭.৫ শতাংশ) ম্যাঙ্গানিজ ১.৩, ফসফরাস ৩৪৭ মিলিগ্রাম, দস্তা ২.৪ মিলিগ্রাম (২২ শতাংশ)। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নিয়াসিন ৪৪শতাংশ, পেনটোথেনিক এসিড, রাইবোফ্লেবিন ২২শতাংশ, থায়ামিন বি১, ভিটামিন এসহ আরও অনেক পুষ্টি উপাদান।
ঢেমশির বীজ বোনার সময় হলো কার্তিক অগ্রহায়ণ মাস। ১০ থেকে ১৫ দিন এদিক-সেদিক হলেও কোনো সমস্যা হয় না। কাটা হয় মাঘ-ফাল্গুন মাসে। বীজের হার প্রতি একরে ১২ কেজি। এক চাষ দিয়ে ছিটিয়ে বা লাইনে বুনা যায়। আবাদে উৎপাদনে তেমন কোনো সারের দরকার হয় না। শুধু পরিমাণ মতো জৈবসার জমিতে দিলেই চলবে। জীবনকাল ৮০ থেকে ৯০ দিন। দুই ফসলে মধ্য ফসল হিসেবে আবাদ করা যায়। সাধারণভাবে উৎপাদন একরপ্রতি ১ টন। ভালো ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে ফলন ২ মেট্রিক টন পর্যন্ত হতে পারে। কাটার পর গাছ জ্বালানি হিসেবে যতটুক ব্যবহার করা যায় তার চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় গোখাদ্য হিসেবে। কেননা গাছে এবং বীজের তুষে বেশ পুষ্টি আছে সে কারণে গোখাদ্য হিসেবে অনেক পুষ্টিকর লাভবান। কোনো পোকামাকড়ের আক্রমণ নেই বলতে গেলে। উৎপাদন মৌসুমে সাধারণত কোনো সেচ লাগে না। লাগানোর ৩০ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে ফুল আসে। ফুল আসার আগ পর্যন্ত ঢেমশি পুষ্টিকর শাক হিসেবে খাওয়া যায়। শাক একটু টকস্বাদযুক্ত। ফুল আসার ১ দেড় মাসের মধ্যে পরিপক্ব হয় ফসল কাটা যায়। সাধারণত ভাত হিসেবে খাওয়া হয়। আর চালের মতো ভেজেও খাওয়া যায়।
জমি তৈরি কওে শেষ চাষের আগে একরে ১২ কেজি বীজ ছিটিয়ে দিয়ে চাষ ও মই দিতে হয়। বপনের আগে পর্যাপ্ত পরিমাণ মতো শুধু গোবর সার দিতে হবে। জমিতে রস না থাকলে ২০ দিন পরপর হালকা সেচ দিলে গাছের বাড়বাড়তি ভালো হয়। যেহেতু কোন বালাইয়ের আক্রমণ নেই তাই কোনো বালাইনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। ঢেমশি নিজেই আগাছা দমন করে। ঢেমশি একর প্রতি প্রায় ১ টন ফলন দেয় এবং মধু পাওয়া যায় প্রায় ১২০ কেজি। ঢেমশির বাজারমূল্য প্রতি টন ২৫ হাজার টাকা এবং মধু ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা প্রতি কেজি। ঢেমশি থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং মধু থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করা যায় একরপ্রতি প্রতি মৌসুমে। বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ঢেমশি কেনার নিশ্চয়তা দেয়। ঢেমশি ভাত রান্না করতে পানি কম লাগে এবং মাত্র ১০ মিনিটে সেদ্ধ হয়। সুতরাং পানি এবং জ্বালানি সাশ্রয় করে। ঢেমশির ভাত পরিমাণে বাড়ে, ১ কেজি চালের ভাত ৮ জন খেতে পারলে ঢেমশি ভাত খেতে পারবে ১২ জন।
লবণাক্ত এলাকায়ও ভালো বাড়বাড়তি এবং ফলন হয়। সময়ের নানা পালা বদলে গুরুত্বপূর্ণ এ ফসলটির চাষ হারিয়ে গেছে। ঢেমশির চাষ বিশ্ব ভুবনে রাশিয়া, ইউক্রেন, কাজাখস্তান, ব্রাজিল, বেলারুশ, ফ্রান্স, লিথুয়ানিয়া, তানজানিয়া, লাটভিয়া, ভুটান, কোরিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, বসনিয়া হার্জেগোবিনা, চীন, পোল্যান্ড, কানাডা, জাপান, কোরিয়া এবং আমেরিকায় উল্লেখযোগ্য হারে আবাদ হচ্ছে। ঢেমশি চাল, আটা, মধু বিদেশে রপ্তানি করে শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। ঢেমশি দিয়ে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যেতে এ কথা নিশ্চিত। শুধু দেশেই নয় বিদেশের বাজারও অনায়াসে ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে। দেশকে পুষ্টিতে তুষ্টিতে আরও সমৃদ্ধ বেগবান করতে পারবে। ঢেমশি ভাতের সুবিকল্প হিসেবে, মেডিসিনাল মূল্যমান হিসেবে ব্যবহার স্বীকৃত।