কোভিড মহামারি প্রায় ১০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে
রাশিদ রিয়াজ : গত বসন্তে যখন কোভিড-১৯ মহামারি আঘাত হানে তখন দিপালী রায় এবং তার স্বামী প্রদীপ রায় বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিক ছিলেন, সেই সময়ে তাদের কারখানায় ব্যাপক ছাঁটাই শুরু হয়েছিল। সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের মতো, দুজনেই রাজধানী ঢাকায় তাদের চাকরি হারান। একসময় যেখানে তারা প্যান্ট, শার্ট এবং জ্যাকেট তৈরির জন্য বছরের পর বছর কাজ করেছিলেন মুহূর্তের মধ্যে সেই চাকরি চলে যায়। সেই সময়ে দিপালী রায়ের খাওয়ার সামর্থ্য পর্যন্ত ছিল না। অন্যান্য অগণিত অভিবাসীদের মতো, তারাও সংসারের খরচ কমাতে গ্রামাঞ্চলের বাড়ি যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সিএনএন
বিশ্বব্যাংকের অনুমান, ২০২০ সালে মহামারিজনিত কারণে সারা বিশ্বে ৯৭ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েছিলেন, যাদের দিনে রোজগার ২ ডলারেরও কম। তারপর থেকে সামান্য উন্নতি হয়েছে এই পরিস্থিতির। বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদরা এই বছরের শুরুতে একটি ব্লগে বলেছিলেন, ২০২০ সালে মানুষ যে হারে দারিদ্রের মুখে পড়েছিলেন সেই পরিস্থিতি এবছরেও বর্তমান। সারাবিশ্বে ৯৭ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছেন আর অপেক্ষায় আছেন কখনে এ দুঃসহ পরিস্থিতি কেটে যাবে।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি গ্রামে খুপরি ঘরে সাক্ষাৎকার দেবার সময় দিপালী রায় জানান, সেই সময়ে আমাদের কাছে বাড়ি ফেরার পয়সাটুকু পর্যন্ত ছিল না। এ দম্পতি যখন জীবিকা অর্জনের নতুন উপায় খুঁজছিলেন, সেই সঙ্গে শুরু হয়েছিল বেঁচে থাকার জন্য তাদের নতুন সংগ্রাম। তারা একটি ছোট ব্যবসা শুরু করার জন্য ঋণ পাবার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু প্রথমে কেউ তাদের সাহায্য করতে রাজি ছিল না। কিছু স্থানীয় অলাভজনক সংস্থা জামানত চেয়েছিল, যা তাদের কাছে ছিল না। কৃষিক্ষেত্রে চাকরির আশায় প্রদীপ রায় কয়েকজন কৃষকের কাছে যান। কিন্তু তার স্ত্রী দিপালী জানাচ্ছেন , তার স্বামী ঢাকার মানুষ হওয়ায় তাকে কেউ চাকরিতে রাখতে চাইছিলেন না, যুক্তি ছিল তিনি নাকি কঠোর আবহাওয়ার মধ্যে কাজ করতে পারবেন না। সর্বোপরি, খাদ্য ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা, বলছিলেন ২০ বছর বয়সী দিপালী রায়। যিনি সেই সময়ে গর্ভবতী ছিলেন এবং কখনও কখনও পাবলিক রেশনিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে দিনে হয়তো একবার খাদ্য জুটতো কপালে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২০ সাল বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের একটি ইতিহাস রচনা করে গেছে। গত ২০ বছরের মধ্যে বিশ্বে দরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি । বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্য ও ইক্যুইটির গ্লোবাল ডিরেক্টর ক্যারোলিনা সানচেজ-পারামো মহামারীটিকে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে তুলনা করেছেন যা দ্রুত পূর্ব এশিয়ায় এর কেন্দ্রস্থল ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। তিনি সিএনএন বিজনেসকে সাক্ষাৎকার দেবার সময় এই মহামারিকে সুনামির সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই অর্থনৈতিক ধাক্কা বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও আঘাত হানবে বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।
এই মহামারি লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্রের দিকে ঠেলে দিলেও অতি-ধনীরা আরও ধনী হয়ে উঠেছেন । ওয়ার্ল্ড ইনইক্যালিটি ল্যাব অনুসারে, গত বছর, বিলিয়নেয়াররা তাদের সম্পদের সর্বোচ্চ বৃদ্ধি উপভোগ করেছেন। জানুয়ারিতে প্রকাশিত অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, মহামারী চলাকালীন বিশ্বের ১ হাজার ধনী ব্যক্তির তাদের ভাগ্য পুনরুদ্ধার করতে মাত্র নয় মাস সময় লেগেছিল। কিন্তু যারা এতটা ভাগ্যবান নন তাদের এই ধাক্কা সামলাতে হয়তো এক দশকেরও বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক, শামেরান আবেদ বলছেন , বিশ্বের তিনজন ধনী ব্যক্তি সম্ভবত পৃথিবীর অতি দারিদ্র্য মুছে ফেলতে পারে। নভেম্বরে, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির পরিচালক বিশ্বের দুই শীর্ষ ধনী ব্যক্তি জেফ বেজোস এবং ইলন মাস্ক সহ বাকি বিলিয়নেয়ারদের এই কঠিন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। সিএনএন-এর বেকি অ্যান্ডারসনের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে, ডেভিড বিসলে বলেছেন মাস্ক যদি তার মোট সম্পদের প্রায় ২ শতাংশ প্রদান করেন তাহলে তা বিশ্বের ক্ষুধা দূর করতে সাহায্য করতে পারে। এ প্রসঙ্গে টেসলার কর্ণধার মাস্ক জানান, যদি ঠিকমত তহবিল গঠন করা হয় তাহলে তিনি এখনই টেসলার স্টক বিক্রি করতে রাজি আছেন।
ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক, শামেরান আবেদ, যিনি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্যদের সাথে এই বিষয়ে কাজ করেছেন, তিনি বলেন, দারিদ্র্য আসলে একটি নীতিগত পছন্দ। কিভাবে এই দারিদ্র থেকে বেরিয়ে আসা যায় তা আমাদের অনেকেরই জানা আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম কাজটি হল টিকাদানে মনোনিবেশ করা। সানচেজ-পারামো-র মতে , আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে প্রত্যেকেরই মহামারীটির সঙ্গে লড়ার জন্য অন্তত ভ্যাকসিন নেয়া আছে।
কারণ আপনি যতক্ষণ না স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, ততক্ষণ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়ে চিন্তা করা খুব কঠিন। তিনি বলছেন, সরকারগুলিকে তাদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে পুনরায় সক্রিয় করার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, যেমন পরিষেবা খাতে। গত দুই বছরে, বিশ্বজুড়ে সরকারগুলি তাদের নিজ নিজ অর্থনীতিকে সমর্থন করার জন্য উদ্দীপক প্যাকেজ তৈরি করেছে। তবে এই মুহূর্তে নতুন করে ছাঁটাইয়ের পথে না গিয়ে দুর্বল পরিবারগুলির জন্য কর্ম সংস্থান আগে প্রয়োজন বলে মনে করেন সানচেজ-পারামো।
তবে এখন রায় দম্পতির দিন ভালো কাটছে। ৪০ হাজার টাকা ঋণ পাওয়ার পর দম্পতি নিজেদের ভরণপোষণের জন্য একটি ভ্যান এবং একটি ছাগল কিনেছিলেন। প্রদীপ রায় এখন ভ্যান চালান দিনে তার রোজগার ৬ ডলারের মত। আপাতত পরিবারটির শহরে ফেরার কোনো পরিকল্পনা নেই এবং এখন কিছু কৃষি জমি কেনার জন্য টাকা সঞ্চয় করছেন তারা। দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এলেও করোনভাইরাস তাদের বড় শিক্ষা দিয়ে গেছে। দিপালী রায়, যিনি গর্ভবতী থাকাকালীন ক্ষুধার যন্ত্রণাকে তার জীবনের ‘সবচেয়ে বেদনাদায়ক’ সময় হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন, তিনি আজ বলছেন – ‘যদি আমি সেই সময়ের কথা মনে করি তাহলে আজও আমার হৃদয় কান্নায় ভরে যায়।’ তবে সেই দুঃস্বপ্নের রাত এখন কেটে গেছে , রায় দম্পতির জীবন এখন ভালোই কাটছে। তারা স্বপ্ন দেখছেন যে, তাদের ছয় মাসের ছেলেকে পড়াশোনা শিখিয়ে স্নাতক করবেন। সেই সঙ্গে প্রদীপ রায়ের আবেদন : আমাদের মতো অনেক লোকই সমস্যার মধ্যে আছে। আপনি যদি তাদের পাশে দাঁড়ান তবে তারাও আমাদের মতো ধীরে ধীরে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।