যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় : প্রধানমন্ত্রী
অর্থনীতি ডেস্ক : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার বিচার সম্পন্ন হলেও হত্যা চক্রান্তের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদেরকেও খুঁজে বের করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদেশে পলাতক বঙ্গবন্ধুর খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে না দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেন সরকারপ্রধান। যুক্তরাষ্ট্র মুখে গণতন্ত্র আর ন্যায় বিচারের কথা বললেও খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে মঙ্গলবার বিকেলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রকাশিত মুজিব স্মারকগ্রন্থ ‘বঙ্গবন্ধু ও বিচার বিভাগ’ ও ‘বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড দ্য জুডিশিয়ারি’ এবং মুজিববর্ষ স্মরণিকা ‘ন্যায় কন্ঠ’-এর মোড়ক উন্মোচন করে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন সরকারপ্রধান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা পরবর্তী রাজনীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আইনের শাসন কায়েম হবে। আইনে বিশ্বাস করি। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে কী হয়েছিল? বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কেঁদেছে। ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স পাস হলো। সেই অর্ডিন্যান্সে বলা হলো, ওই খুনীদের কোনোদিন বিচার করা যাবে না। ওই হত্যায় মামলা করা যাবে না।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ সব অধিকার হারিয়েছিল বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কারবালাতেও বোধহয় শিশু-নারীকে এভাবে হত্যা করা হয়নি। কারবালার ঘটনাকেও হার মানিয়েছিল ১৫ আগস্টের ঘটনা।’
বঙ্গবন্ধুর খুনী রাশেদ চৌধুরীকে আশ্রয় দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা করতেও ছাড়েননি শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা যুক্তরাষ্ট্রের মতো জায়গা, তারা সবসময় ন্যায় বিচারের কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলে, ভোটাধিকারের কথা বলে, তারা মানবাধিকারের কথা বলে, কিন্তু আমাদের যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছিল, আমরা যে ন্যায়বিচার পাইনি, তারপর যখন এই বিচার হল, তখন খুনিদের আশ্রয় দিয়ে বসে আছে। ‘আমি ক্ষমতায় আসার পর বার বার যতজন রাষ্ট্রপতি এসেছেন প্রত্যেকের কাছে বার বার অনুরোধ করেছি যে একটা সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে আপনারা কীভাবে আশ্রয় দেন। আপনাদের জুডিশিয়ারি কীভাবে আশ্রয় দেয়। কীভাবে একটা খুনিকে আশ্রয় দেন,’ যোগ করেন সরকারপ্রধান।
বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীর কর্মকা-ও ওঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর বয়ানে। তিনি বলেন, ‘যেই খুনিটা ১৫ আগস্ট যখন আমার সেজ ফুফুর বাড়ি আক্রমণ করে সেখানে যে গ্রুপটা যায়, সেখানে কমান্ডিং অফিসার ছিল ওই রাশেদ। সেই খুনি এখনও আমেরিকায়। তাকে আজ পর্যন্ত কেউ ফেরত দিল না। আমেরিকা গণতন্ত্রের জন্য কথা বলে আর খুনিদের আশ্রয় দেয়, প্রশ্রয় দেয়। কেন? আমি জানি না। তারা নাকি সব থেকে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশ। প্রত্যেক রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দিয়েছি, বার বার অনুরোধ করেছি, আমরা বারবার চেষ্টা করেছি।’
অন্যদিকে খুনি নূর চৌধুরীকে কানাডা আশ্রয় দিয়ে রেখেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) কাছ থেকে আমাদের আইনের শাসনের ছবকও শুনতে হয়, গণতন্ত্রের কথাও শুনতে হয়, ন্যায় বিচারের কথাও শুনতে হয়। সেটাই আমার কাছে খুবই অবাক লাগে।’
বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন, সংগ্রামমুখর জীবন ও কারাগারে অন্তরীণ দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি হিসাব করে দেখি, আমি তো মানে বাবাকে বাবা বলে ডাকা, যে বয়সে একটা বাচ্চা বাবার হাত ধরে স্কুলে যায় সেই সুযোগটা আমাদের জীবনে কমই এসেছে, আসেনি বলতে গেলে।’
কলঙ্কিত ঘটনার উদাহরণ থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার কখনও বিচার বিভাগতে কলঙ্কিত হতে দেয়নি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিচারকার্যে কখনও হস্তক্ষেপ করেনি। এর আগে অনেক ঘটনা আছে, আপনারা জানেন। দেখা গেছে, ফলস সার্টিফিকেটের ব্যবহার, ছাত্রদলের কাঁধে হাতে রেখে কাকে কী রায় দেয়া হবে, সেই আলোচনা। এরকম বহু ন্যাক্কারজনক ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে।’
‘ন্যায়ের পথে যেন সবাই চলতে পারে, আমরা সেই ব্যবস্থা করেছি’ বলেও মন্তব্য তার।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এইটুকু অন্তত বলতে পারি, আমরা ক্ষমতায় আসার পর, পরপর তিনবার আমরা ক্ষমতায়, এর আগেও একবার ছিলাম। আমরা কখনও এসব করার সুযোগ দেইনি।’
বিচারিক আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত অনুবাদ শাখা খুলে আদালতের রায় বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশে বিচার বিভাগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে দেশের সবার পক্ষে রায় পড়া সহজ হবে।
১৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনীতি প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘যদিও প্রথমে ক্ষমতায় এসেছিল আমার বাবারই মন্ত্রিসভার মন্ত্রী খন্দকার মুশতাক। সেটাও সংবিধান লঙ্ঘন করে তার ক্ষমতায় আরোহণ। কয়েকজন জুনিয়র অফিসার, তাদের সঙ্গে উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার জিয়াউর রহমান ওতোপ্রোতভাবে জড়িত এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারই প্ররোচনায় এই ঘটনা। এর সঙ্গে যে ষড়যন্ত্রকারী ছিল, সেটা এখনও বের করা হয়নি। একদিন সেটাও বের হবে।’
দীর্ঘ অপেক্ষার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হওয়ায় দেশবাসী ও বিচার বিভাগের প্রতি সন্তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এখন আরেকটা দায়িত্ব রয়ে গেছে। চক্রান্তকারীদের খুঁজে বের করা। এটা একদিন বের হবেই। এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জিয়াউর রহমান সংবিধান লংঘন করে সেনাপ্রধান ও দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘সে তখন ঘোষিত রাষ্ট্রপতি প্লাস সেনাবাহিনী প্রধান। আমার প্রশ্ন, গণতন্ত্রটা তাহলে কোথায়? আমাদের অনেকেই যে তার পেছনে খুব বাহবা দিয়ে নেমে পড়ল হাতে তালি দিয়ে গণতন্ত্র পেয়েছে।’ এরপর জিয়াউর রহমানের রাজনীতিক হতে চান বলেও জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘তখন রাজনীতিবিদ হতে আর কোনো লজ্জা থাকল না। তখন উর্দি খুলে দল গঠন। আর ক্ষমতায় উত্তরণ করে তার রাজনীতিতে আসা এবং এর পর দলগঠন করলে খুব স্বাভাবিকভাবেৃআর দলগঠন করতে যেয়ে বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী, নির্বাচিত প্রতিনিধি যে যেখানে ছিল, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সবাইকে চাপ দিয়ে দিয়ে দলে ভেড়াল।
‘আর যে দলে না ভিড়বে তাকে তো ভোগ করতে হবে অত্যাচার নির্যাতন, মিথ্যা মামলা। নির্যাতন করে করে অনেককে দেলে ভেড়ানো হলো। কেউ লোভে আসল, কেউ অত্যাচারিত হয়ে আসল, কেউ নির্যাতিত হয়ে আসলে। এভাবেই তার দলগঠন। সেই দলটা হল বিএনপি।’
আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় না এলে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার কোনোদিনও হতো না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যদিও এই বিচারের রায় দিতে যেয়ে বা বিচার করতে গিয়ে উচ্চ আদালতে অনেকেই আমি জানি যে, সেই সাহসটা পাননি, একটা পর্যায়ে সরে গেছেন। কেন সেটা আমি জানি না। তারপরেও আমি বলব, এই বিচারের রায় আমরা পেয়েছি, এই বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। এখনও কয়েকজন ফিউজিটিভ আছে, তারা পালিয়ে আছে। তাদেরকেও খোঁজা হচ্ছে।’ বাসস