৫ মাসে ৩ লাখ কোটি টাকার এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা
অর্থনীতি ডেস্ক : করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমার পর দেশে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার বন্যা বইতে শুরু করেছে। প্রতি মাসেই রেকর্ড হচ্ছে। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে ৮১০ কোটি ৭০ লাখ (৮. ১০ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।
বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এক মাসে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে এত বিপুল অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা খরচ দেখা যায়নি।
এর আগে গত অক্টোবর মাসে ৭৪২ কোটি ১৬ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল; যা ছিল এক মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩৫ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন (৩ হাজার ৫৪২ কোটি ৯২ লাখ) ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৩ লাখ ৩ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে ২৩ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই পাঁচ মাসে দেশে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৫৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এই পাঁচ মাসে গড়ে ৭ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে দেশে।
আর এলসি খোলার এই হিড়িকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভেও টান পড়েছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করায় সে সব দেশের মানুষ আগের মতো পণ্য কেনা শুরু করেছিল। দেশের পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। সব মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সব ধরনের পণ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে গিয়েছিল।
সে চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা নতুন উদ্যমে উৎপাদন কর্মকা-ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সে কারণেই শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ (ক্যাপিটাল মেশিনারি) সব ধরনের পণ্য আমদানিই বেড়ে গিয়েছিল, বেড়েছিল এলসি খোলার পরিমাণ।
এ ছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ অন্য সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এলসি খুলতে বেশি অর্থ খরচ হয়েছে বলে জানান তারা।
তবে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের ধাক্কায় ফের বেসামাল বিশ্ব অর্থনীতি; আতঙ্ক ছড়িয়েছে বাংলাদেশেও। এ অবস্থায় আগামী দিনগুলোতে বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলবেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য আমদানির জন্য ৬ হাজার ৭০৪ কোটি (৬৭.০৪ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলেছিলেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। ওই অঙ্ক ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার এলসি খোলার সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-নভেম্বর সময়ে এলসি খুলতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা খরচ হয়েছে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল কাপড় ও অন্য পণ্য আমদানিতে; সেটা ৫০৫ কোটি ৮০ লাখ (৫.০৫ বিলিয়ন) ডলার, গত বছরের একই সময়ের চেয়ে যা ৪৬ শতাংশ বেশি।
সুতা আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ২০৭ কোটি ২৬ লাখ ডলারের; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫১ দশমিক ২২ শতাংশ। তুলা সিনেথেটিক ফাইবার আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১৪৬ কোটি ১৭ লাখ ডলারের। বেড়েছে৩৬ দশমিক ১২ শতাংশ।
রাসায়নিক দ্রব্য ও সার আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ২১২ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৫ শতাংশ। এছাড়া ওষুধের কাঁচামালের এলসি খোলা হয়েছে ৪৮ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের; বেড়েছে ২৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির জন্য ২৩৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, বেড়েছে ২১ দশমিক ০২ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৩০৬ কোটি ৬৩ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫২ দশমিক ১০ শতাংশ। অন্যান্য শিল্প যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৯৪৯ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের; বেড়েছে ৩৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
এ ছাড়া জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ১৭০ কোটি ১৪ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি; ১১৪ দশমিক ০৩ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মধ্যে চাল আমদানির এলসি খোলঅ হয়েছে ৩২ কোটি ৫ লাখ ডলারের; বেড়েছে ১৩৭৭৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ। গম আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৯৪ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। বেড়েছে ৪৯ দশমিক ১৭ শতাংশ।
চিনি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৩৯ কোটি ৩০ লাখ ডলারের। প্রবৃদ্ধি ১০১ দশমিক ৪২ শতাংশ। ভোজ্যতেল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৭১ কোটি ডলারেরর; বেড়েছে ৫৬ দশমিক ১৩ শতাংশ।
আমদানি বাড়ায় বাংলাদেশের বিদেশি রিজার্ভও কমছে, নেমে এসেছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে। গত কয়েক দিনে তা বেড়ে ৪৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। সোমবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ৪৫ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ৭ বিলিয়ন ডলার হিসেবে বর্তমানের এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়।
গত ৪ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১১৩ কোটি ১০ লাখ ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা ছিল সাত মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
বেশ কয়েক বছর ধরে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। একের পর এক রেকর্ড হয়। করোনাকালে আমদানিতে ধীরগতি আর রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ঊর্ধ্বগতির কারণে গত ২৪ আগস্ট বাংলাদেশের অর্থনীতির এই সূচক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে, যা ছিল অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। সূত্র : নিউজবাংলা, জাগোনিউজ, বাংলানিউজ। গ্রন্থনা : শোভন দত্ত