
মার্কিন স্যাংশনের নেপথ্যে

আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল
মার্কিন স্যাংশন নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই এটা যেমন সত্যি, এটাও সত্যি যে এর সঙ্গে এমন কিছু বিষয় যুক্ত যা প্রভাব ফেলতে পারে। এটি একদিনে হয়নি। বিএনপি-জামায়াত প্রচলিত আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের চেষ্টা করেছে। ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিলো খালেদাকে গ্রেপ্তারের পর ন্যূনতম প্রতিবাদ গড়ে তুলতে না পারা। তারপরই তারা অনলাইন প্রচারণা ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের কৃপা লাভকে ক্ষমতায় আরোহনের প্রধান কৌশল হিসেবে নির্ধারণ করে। ১৯৭৫ পরবর্তী ও ২০০৮ পূর্ববর্তী সময় বাংলাদেশ ছিলো বৈদেশিক অনুদান ও ঋণনির্ভর একটি রাষ্ট্র। দাতাদের প্রেসক্রিপশন আমলে নিয়ে চলতে হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম একটি রাষ্ট্র যা বিশ্বে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। গত এক দশকে আন্তর্জাতিক যতো চুক্তি ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে আগের মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্রের স্বার্থ প্রাধান্য না দিয়ে উভয় পক্ষের স্বার্থ নিশ্চিত করা হয়েছে। ‘জি হুজুর’ নীতি অনুসরণ না করে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সকল বন্ধু দেশকে সমভাবে প্রধান্য দিয়ে সম্পর্ক অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যে গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সরাসরি প্রতিকূল না হলেও, যুক্তরাষ্ট্র যে অদৃশ্য কলোনী প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেই স্বার্থের পক্ষে তা অনুকূল নয়। এক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজন একটি আজ্ঞাবাহী সরকার। তাই এ মিশনে যুক্ত করা হয়েছে দালাল গোষ্ঠী- নব্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস।
স্যাংশনের নেপথ্যে: হাস্যকর অভিযোগে দেওয়া সাম্প্রতিক মার্কিন স্যাংশন কেন দেওয়া হয়েছে, মূল উদ্দেশ্য কী- এসব নিয়ে বিভিন্ন মত থাকতে পারে। আমার পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে মূল উদ্দেশ্য আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভীতি সৃষ্টি করা। এটি করতে পারলে তাদের অন্য পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন সহজ হবে। মার্কিন স্যাংশনটি অর্থনৈতিক এবং বিশেষ ব্যক্তিদের এর টার্গেট করা হয়েছে। র্যাব তথা প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখার জন্য। ভবিষ্যতেও অর্থনৈতিক কোনো নীতি গ্রহণ করলে সেটিও হবে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট করে। কিন্তু এতে লাভ কী?
মার্কিন স্যাংশনের কারণ ও প্রভাব: [১] স্যাংশনে র্যাবের নাম এলেও মূলত টার্গেট পুলিশ বিভাগ। যে সাতজনের বিরুদ্ধে স্যাংশন দেওয়া হয়েছে তারা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করেনি- এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে তারা ধারণ করেন। আগামী ২/৩ বছরে, বিশেষত আগামী নির্বাচনে তারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু আজ্ঞাবাহী সরকার প্রতিষ্ঠায় সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজন অনুগত কর্মকর্তা। তারা ধারণা করেছে- এ স্যাংশনের ফলে উক্ত কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেওয়া যাবে এবং পরবর্তী সময় আইজিপি বা র্যাব প্রধান হিসেবে তাদের কাউকে নিয়োগ দিতে সরকার দ্বিধায় পড়বে। [২] শীর্ষ পদগুলোতে আগামীতে কারা আসবে তার একটি ছক সম্ভবত তারা করে রেখেছে। কারা তাদের নির্দেশ পালনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে, তাদের পথ সুগম করবে- তারা এটা নিশ্চিত করতে চায়। ভবিষ্যৎ কর্মকর্তাদের তারা অলিখিত আল্টিমেটাম দিতে চায় যে- ‘আমাদের সহায়তা না করলে কিন্তু আমেরিকায় আসতে পারবেন না’, ‘ভিসা/মাস্টারকার্ড ব্যবহার করতে পারবেন না।’ তাদের সমর্থনপুষ্ট কেউ না এলেও তিনি হয়তো তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত থাকবেন। যতো বড় জঙ্গি/সন্ত্রাসী হোক, যেকোনো ধরনের অন্যায়ই করুক না কেন- সরকারবিরোধী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়তো দ্বিধায় থাকবেন।
[৩] দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা ও পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ প্রসারিত হতে পারে। রোহিঙ্গারা উগ্র থেকে উগ্রতর হয়ে উঠবে। নিষ্ক্রিয় মাদক ব্যবসায়ীরা আবার সক্রিয় হবে। এছাড়া আন্দোলনের নামে সহিংসতা সৃষ্টিতে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেওয়া হলো। এসবের কারণে অনেকে ধারণা করবে যে- এখন জঙ্গি তৎপরতা চালালে বা মাদক কারবার করলে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর হামলা চালালেও পাল্টা গুলি নাও করা হতে পারে। আন্দোলনের নামে সহিংসতা চালালেও তা মানবাধিকারের আওতায় চলে আসবে। অর্থাৎ অস্থিতিশীলতা। [৪] পুলিশ ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে এজেন্ট তৈরি বা এজেন্টদের সক্রিয় করা তাদের লক্ষ্য। সরকারের পক্ষে দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত ‘আকাম-কুকাম’ ফাঁস করার অথবা ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা হতে পারে। ছাত্রী সংস্থার সদস্যরা নারীলোভী দায়িত্বশীলদের ফাঁসানোর চেষ্টা করে- এটি নতুন কিছু নয়। এখন তা শৈল্পিকভাবে ব্যবহার করা হতে পারে।
মার্কিন স্যাংশনের অন্যতম প্রধান কারণ- ‘সরকার তো বিপদে আছে’- এমন বার্তা মনে করে সরকারপন্থি/দলীয় অনেকে কেটে পড়বে। নিষ্ক্রিয়রা সক্রিয় হবে না। কেউ আবার লিয়াজোঁ করার চেষ্টা করবে। ইতিহাস বলে, ২০০১ এর নির্বাচনের পর এ জাতীয় ব্যক্তিরাও বিএনপি-জামায়াতের আক্রোশ থেকে রক্ষা পায়নি। বিশেষত সরকারি কর্মকর্তারা চাকরিচ্যুত বা মামলা/শাস্তির শিকার হয়েছে। এ ধারা অস্বাভাবিক নয়। দলের মূলধারার নেতাকর্মীরা বরাবরই বসন্তের কোকিল বিরোধী। জামায়াত-শিবিরকে ট্রেনিং দেওয়া হয়- বিপদে পড়লে আগে অন্য দলের পরিচিতদের থেকে সাহায্য নিতে। বিপদ কেটে গেলে হুকুমত কায়েমের নামে তারই রগ কাটে তারা। পিনাকিচন্দ্র বিদ্যাপুকুর ২০১৫ এর আগে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে কী কটাক্ষ করেছে সেগুলো দিয়ে তাকেই সাইজ করা হবে। বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিলো, বাবুনগরীর সঙ্গে ৪৫ মিনিট কথা বলেছি- এসব ইতিহাস জাহাঙ্গীরকে ‘মাইর’ থেকে বাঁচাবে না। তার পোষা সুন্দরী হুজুরই প্রথমে তার উপর হামলা করার ওয়াজ করবে। চলার পথে সংকট আসবেই। যতো বড় সংকট হোক, তা থেকে উত্তরণের উপায়ও থাকে। কিন্তু সবচেয়ে বড় শক্তি জনগণের পাশে থাকা, তৃণমূল কর্মীদের নিয়ে থাকা। এই শক্তির কাছে সকল পরাশক্তি তুচ্ছ। মার্কিন স্যাংশন আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফেসবুক থেকে
