সম্ভাবনাময় চিংড়ি খাতের নেই টেকসই উন্নয়নে কার্যক্রম
মতিনুজ্জামান মিটু : সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি উৎপাদনে দেশের অবস্থান আশানুরূপ নয়। অথচ বিগত দশ বছরের মৎস্য রপ্তানির তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক মূল্যমানে বাংলাদেশ হতে মোট মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানিতে চিংড়ির অবদান শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ। বর্তমানে দেশের ২ লাখ ৫৮ হাজার ৬৮১ হেক্টর জলাশয়ে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এরমধ্যে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮১২ হেক্টরে বাগদা এবং ৭৩ হাজার ৮৬০ হেক্টর জলাশয়ে গলদার চাষ হচ্ছে। এদেশে চিংড়ির চাষ পদ্ধতি মূলত সনাতন ও উন্নত সনাতন। বাগদা চিংড়ির উৎপাদন গড়ে প্রতি হেক্টরে মাত্র ৩৩৪ কেজি এবং গলদা চিংড়ির উৎপাদন হেক্টরে ৬৯৮ কেজি। অথচ আধা নিবিড় পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ির উৎপাদন হয় হেক্টরে গড়ে ৪ হাজার ৪১৪ কেজি।
বাংলাদেশে চিংড়ি চাষের ইতিহাস ও বিরাজমান অবস্থা তুলে ধরে সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম জানান, সত্তরের দশকে দেশের দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলে জোয়ারের পানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষের সূচনা হয়। এ চিংড়ি চাষ পরবর্তীতে জাতীয় অথনৈতিক উন্নয়নে এক অমিত সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। ফলে আশির দশকের গোড়ার দিকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন ঘের তৈরি করা হয় এবং স্থানীয় উপকূলীয় জলাশয় থেকে বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণ করে ঘেরে মজুদ করার মাধ্যমে চিংড়ি চাষের গোড়া পত্তন হয়।
এতে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপকূলীয় অঞ্চলে সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড জোরদার হতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিংড়ি চাষ উপযোগী ঘেরের আয়তন বাড়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। কিন্তু সম্ভাবনাময় এ খাতটির টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে তেমন কোন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়নি। এখন অধিকাংশ ঘেরে উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এসব ঘেরের অধিকাংশের অবকাঠামো খুবই দুর্বল প্রকৃতির এবং পানির গভীরতা মাত্র ১ ফুট থেকে ১.৫ ফুট। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতি বর্ষণে এসব অধিকাংশ ঘের সহজেই প্লাবিত হয়ে যায়। এসব ঘেরে কোন বায়োসিকিউরিটি না থাকায় এক ঘেরের মাছ রোগাক্রান্ত হলে রোগের সংক্রমণ অন্যান্য ঘেরেও সহজে ছড়িয়ে পড়ে।
দীর্ঘদিন ধরে এখানে শুধু চিংড়ি চাষ করার ফলে ঘেরগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি চিংড়িতে বিভিন্ন রোগের আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যায়। অপরিকল্পিত ঘেরগুলোর কারণে বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন জায়গায় জলবদ্ধতার সৃষ্টি হতেও দেখা যায়। শুষ্ক মৌসুমে উপকূলীয় অঞ্চলের ঘেরগুলোয় পানির লবণাক্ততা ৮ থেকে ১২ পিপিটি হওয়ার কারণে এখানে মিষ্টি পানির মাছ চাষ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে লবণাক্ততা কমে ০-৫ পিপিটি হলে লবণাক্ত পানির মাছের (বাগদা, ভেটকি, ভাঙান, পারশে ইত্যাদি) পাশাপাশি মিষ্টি পানির মাছও (কার্প, পাবদা, গলদা ইত্যাদি) চাষ করা যায়।
বাগদা চিংড়ির উৎপাদন কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে এমৎস্য কর্মকর্তা জানান, উপকূলীয় অঞ্চলের বাগদা চিংড়ির উৎপাদন কম হওয়ার কারণগুলো হচ্ছে- দুর্বল অবকাঠামো; মানসম্পন্ন পোনার অভাব; খাদ্যসহ চাষের বিভিন্ন উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্য বেড়ে যাওয়া; সনাতন পদ্ধতির চাষ পদ্ধতি; চাষির পুঁজির অভাব; কারিগরি জ্ঞানের অভাব; আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণে সীমাবদ্ধতা; ভাইরাসসহ বিভিন্ন কারণে চিংড়ি মারা যাওয়া।
চিংড়ির টেকসই উৎপাদন বাড়ানো ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে তিনি জানান, উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের জীবন জীবিকা আবর্তিত হয় চিংড়িকে ঘিরে। এখানে চিংড়ি চাষির পাশাপাশি অনেকে রয়েছেন চিংড়ি পোনা ব্যবসায়ী এবং চিংড়ি ক্রেতা ও বিক্রেতা। চিংড়ির সঙ্গে জড়িত সব স্টেকহোল্ডার বা অংশীজনদের টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এবং দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখার জন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চিংড়ির টেকসই উৎপাদন বাড়ানো একান্ত আবশ্যক।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে, ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ সম্পর্কে এ মৎস্যবিদ জানান, ক্লাস্টার হলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত খামার সমষ্টি যা সাধারণত একই অঞ্চল ও পরিবেশে খুব কাছাকাছি স্থানে অবস্থিত হয়। ক্লাস্টার পদ্ধতিতে খামারগুলোর মধ্যে বৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য। একই ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ বা অবকাঠামোর ব্যবহার, (পানির উৎস, বর্জ্য নির্গমন ব্যবস্থা ইত্যাদি); একই বা কাছাকাছি চিংড়ি চাষ পদ্ধতির অনুসরণ; একই প্রজাতির মাছ বা চিংড়ি চাষ বা মিশ্রচাষ করা; উদ্যোগী বা সম-স¦ার্থ সংশিংষ্ট দল হতে হবে। চিংড়ি ক্লাস্টার এমন একটি সংগঠন যা একটি নির্দিষ্ট এলাকার চিংড়ি চাষিদের নিয়ে গঠিত হয় এবং সদস্যরা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সমন্বিত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় টেকসই চিংড়ি চাষে ক্লাস্টার প্রযুক্তির সম্ভাবনা ও ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে সুবিধা প্রসঙ্গে তিনি জানান, এতে চিংড়ির উৎপাদন বাড়ে এবং নিরাপদ চিংড়ি উৎপাদন করা সহজ হয়। বর্তমান চাষ পদ্ধতিতে যে সব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তা থেকে সম্মিলিতভাবে উত্তরণের উপায় বের করা যায়। চিংড়ি চাষে পানির উৎস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ সহজতর ও সাশ্রয়ী হয়। কারিগরি সহায়তা পাওয়া অনেক সহজ হয়। জৈব নিরাপত্তা প্রতিপালনের মাধ্যমে রোগবালাই প্রতিরোধ করে উৎপাদন বাড়ানো যায়। সম্মিলিতভাবে গুনগত মানসম্পন্ন উৎপাদন সামগ্রী সংগ্রহ করা যায় এবং উৎপাদন খরচ কমানো যায়। উৎপাদিত পণ্যের গুণমান নিশ্চিতকরণ সহজতর হয়। উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে অধিক সুবিধার পাশাপাশি যথার্থ মূল্য পাওয়া নিশ্চিত হয়।
ক্লাস্টার ফার্মিং এর আওতায় সংগঠিত চাষি দলের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ বা অন্যান্য সুবিধা পাওয়া অনেক সহজ হয়। ক্লাস্টারভিত্তিক সার্টিফিকেশনের যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে পণ্যের বর্ধিত মূল্য নিশ্চিত হয়। চাষির আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়। নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। প্রতিটি ক্লাস্টার এক একটি সামাজিক সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে। ফলে সামাজিক সম্প্রতি বাড়ে। চিংড়ি সেক্টর অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত। এই খাতের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষ না করে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট জায়গায় পরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষ করতে হবে। এর ফলে একদিকে যেমন নিরাপদ চিংড়ির উৎপাদন বাড়বে, অন্য দিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলোও মোকাবেলা করা সহজ হবে।
বিছিন্নভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন ক্লাস্টার ফার্ম নিয়ে কাজ করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মৎস্য অধিদপ্তরের এসটিডিএফ (এফএও এর কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় এবং ওয়ার্ল্ড ফিস ও বাংলাদেশ শ্রিম্প ও ফিস ফাউন্ডেশনের সহায়তায়) প্রকল্পের মাধ্যমে। প্রকল্পটি ২০১৩-১৪ হতে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত ২ বছরে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলাতে ৪০টি ক্লাস্টার স্থাপন করে। এর সফল ক্লাস্টারগুলো ৭০শতাংশ পর্যন্ত বেশি উৎপাদন পরিলক্ষিত হয়।
ক্লাস্টার বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জগুলো প্রসঙ্গে জানানো হয়, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জলবায়ু পরিবর্তনের পারিপাশির্^কতা বিবেচনা করে উপকূলীয় অঞ্চলের লাগসই প্রযুক্তি হিসেবে ক্লাস্টারভিত্তিক মৎস্যচাষের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত চ্যালেঞ্চগুলো সামনে আসতে পারে। যেমন: সঠিকভাবে ক্লাস্টার নির্বাচন করা। কারণ উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ ঘেরগুলোর আয়তন অনেক বড়। যেগুলো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করাও অত্যন্ত কঠিন; ক্লাস্টারে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। কারণ অধিকাংশ পানি সরবরাহে খালগুলোয় পলি জমে ভরাট হয়েছে।
এ ছাড়া অনেক খাল বিভিন্ন জায়গায় প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাওয়া; ক্লাস্টারের অধিকাংশ ঘের লিজকৃত হওয়ার কারণে ঘেরের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হওয়া। এ ছাড়া চাষিদের পুঁজির অভাব হয়ে থাকে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ক্লাস্টার বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে ক্লাস্টারভিত্তিক চিংড়ি চাষ শুরু করতে পারলে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এ খাতটিকে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। এ প্রযুক্তিতে চিংড়ি চাষ করতে পারলে চিংড়ির টেকসই উৎপাদন বাড়ানো যেমন সম্ভব হবে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।