প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় বাড়ছে গ্রাহক ৩ বছরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন দ্বিগুণ
মো. আখতারুজ্জামান : হ্যালো। তোমার কত টাকা লাগবে? একটু পরে তোমার নম্বরে ১ হাজার টাকা পাঠাচ্ছি। রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় রিক্সায় বসে নিজের মোবাইল ফোনে স্ত্রীর সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন রিক্সাচালক হানিফ। হানিফের বাড়ি রংপুরে। তিনি দীর্ঘ দিন থেকে রাজধানীতে রিক্সসা চালান। তার সঙ্গে কথা হয় তেজগাঁও এলাকায়।
হানিফ বলেন, আগে লোকদের মাধ্যমে গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হতো। পরিবারের লোকজনের হাতে টাকা পৌঁছাতে কয়েক দিন লেগে যেত। এখন মোবাইলের মাধ্যমে কয়েক মিনিটের মধ্যেই টাকা পাঠানো যায়।
হানিফের মতো লাখো খেটে খাওয়া মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রিয়জনদের কাছে টাকা পাঠিয়ে থাকে। ফলে প্রতিদিনই মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বর্তমানে ১৩ ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনা করছে। আর মাত্র ৩৫ মাসের ব্যবধানে এই মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসজুড়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ৬৭ হাজার ৫৮৯ কোটি ৭০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ১৮০ কোটি টাকা, যা একক মাস ও দৈনিক লেনদেনে এ যাবৎকালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অন্যদিকে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে লেনদেন হয়েছিলো ৩২ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। ওই সময় প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছিলো এক হাজার ৩৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে মাত্র ৩৫ মাসের ব্যবধানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয় ৬৫ হাজার ১৪১ কোটি ৪০ লাখ টাকার। ওই মাসে প্রতিদিন লেনদেন হয় দুই হাজার ১৭১ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় সর্বোচ্চ লেনদেন হয় গতবছরের মে মাসে। ওই মাসে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৭১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। আর প্রতিদিন লেনদেনের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অক্টোবর মাস শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়ায়েছে ১০ কোটি ৮১ লাখ ৩৮ হাজার ৮০ জন। এর মধ্যে পুরুষ গ্রাহক পাঁচ কোটি ৯২ লাখ ১২ হাজার ১৯১ জন। আর নারী গ্রাহক চার কোটি ৮৬ লাখ ২৮ হাজার ১৯৪ জন। অন্যদিকে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ছিলো ৬ কোটি ৭৫ লাখ ১৬ হাজার ৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ গ্রাহক তিন কোটি ৫৯ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮৯ জন। আর নারী গ্রাহক তিন কোটি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ৯১০ জন।
চলতি বছরের অক্টোবর শেষে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৫৫ হাজার ১৯১ জন। এর মধ্যে শহরে এজেন্ট ছয় লাখ ৪০ হাজার ১২৬ জন। আর গ্রামের এজেন্ট পাঁচ লাখ ১৫ হাজার ৬৫ জন। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা ছিলো ৮ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭১ জন। এর মধ্যে শহরে এজেন্ট চার লাখ ৮১হাজার ২২ জন। আর গ্রামের এজেন্ট চার লাখ পাঁচ হাজার ৪৪৯ জন।
নগদের হেড অফ কমিউনিকেশন সজল জাহিদ বলেন, এমনিতেই মানুষের জীবন অনেক বেশি ডিজিটাল হচ্ছে। সবাই এখন ডিজিটাল সার্ভিসগুলো গ্রহণ করছে। এছাড়া এমএফএসের বিস্তৃতির ক্ষেত্রে করোনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যে কারণে মানুষ এখন নগদ টাকা কম বহন করে অনেক বেশি ডিজিটাল পেমেন্ট করছে। নগদের মাধ্যমে গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে সাড়ে তিন কোটি মানুষকে সরকার ৮ কোটি বার বিভিন্ন ভাতা দিয়েছে। অর্থাৎ কোন কোন ব্যক্তি একই ভাতা একাধিকবারও পেয়েছেন। এই ভাতাগুলোর পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ছিলো বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।
শুধু অর্থ পাঠানোই নয়, অনেক নতুন নতুন সেবাও মিলছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল পরিশোধ, কেনাকাটার বিল পরিশোধ, বেতন-ভাতা প্রদান ও বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোসহ বিভিন্ন সেবা দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় টাকা জমা পড়ে ২১ হাজার ৪৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর ১৭ হাজার ৬৮১ কোটি ৭০ লাখ টাকা উত্তোলন হয়। এ মাসে কেনাকাটার বিল পরিশোধ হয় দুই হাজার ৯৫৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় টাকা জমা পড়ে ১২ হাজার ২৬১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর ১২ হাজার ২১৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা উত্তোলন হয়। এ মাসে কেনাকাটার বিল পরিশোধ হয় মাত্র ৪৮৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
গত বছরের অক্টোবরে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার করে ব্যক্তির হিসাব থেকে আরেক ব্যক্তির হিসাবে ১৯ হাজার ৭১০ কোটি ৪০ টাকা পাঠানো হয়। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার করে ব্যক্তির হিসাব থেকে আরেক ব্যক্তির হিসাবে পাঁচ হাজার ৭৩ কোটি ৭০ টাকা পাঠানো হয়।