কাজাখস্তানের কোটি কোটি ডলার গেছে লন্ডনে
অর্থনীতি ডেস্ক : যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন ২০১৬ সালে দুর্নীতিবিরোধী একটি সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে গোপনে যুক্তরাজ্যে সম্পদ গড়ার সুযোগ বন্ধ করবেন। এর পাঁচ বছর পর একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, বিদেশি যারা যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, তাদের নিবন্ধন করা হবে। কিন্তু এখনো এই পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হয়নি। আর এই সুযোগই নিয়েছেন কাজাখস্তানের ধনী ব্যক্তিরা।
যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, কাজাখস্তানের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তারা ধনীদের লন্ডনে বাড়ি কেনাসহ সম্পদ গড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। যে অর্থ লন্ডনে বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা মূলত দেশটির সম্পদ। মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ওঠার কারণ হলো, তারা দুর্নীতি ঠেকাতে সম্পদের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে আইন প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছেন।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে কাজাখস্তানে সম্প্রতি বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। এ বিক্ষোভ শুধু জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে নয়। কাজাখস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নাজারবায়েভের তিন দশকের শাসন এবং তার শাসনামলে অল্প কিছু মানুষ যে সুবিধা পেয়েছেন, এর বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ এ বিক্ষোভ। কাজাখস্তানের ধনিক শ্রেণি দুই দশক ধরে লন্ডন ও ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে সম্পদ কিনেছেন। এ সময়ের ব্যবধানে শত শত কোটি মার্কিন ডলারের সম্পদ কিনেছেন তারা। এখন ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে এসব সম্পদের নিবন্ধনের ব্যাপারে আইন পাসের জন্য।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সরকার এখনো এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নেওয়ায় সমালোচনা শুরু হয়েছে দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে। দেশটির ছায়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেন, মানি লন্ডারিং, দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থ অর্জন ঠেকাতে যুক্তরাজ্যের যে ভূমিকা, তা পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে এ সরকার। যেসব শাসক শ্রেণি নিজ দেশের সম্পদ লুট করেছেন, তাদের গন্তব্যে পরিণত হচ্ছে লন্ডন। এমন অবস্থানে থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কিংবা কাজাখস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলা সমীচীন নয় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
যুক্তরাজ্যে এমন গোপনে সম্পদ গড়ে তোলার ঘটনা একেবারে নতুন নয়। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ৯০ হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলোর মালিক মূলত বিদেশিরা। এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে গোপনে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক চ্যাথাম হাউস সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স নামেও পরিচিত। তারা বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে ৩৪টি সম্পত্তি কিনেছেন কাজাখস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ সম্পদের মূল্য ছিল ৭২ কোটি মার্কিন ডলার।
ইংল্যান্ডের এক্সেটার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও এ প্রতিবেদনের প্রধান লেখক জন হেথারশ বলেন, কাজাখস্তানে যারা সম্পদ কিনেছেন, তাদের অধিকাংশই নুরসুলতান নাজারবায়েভের পরিবারের সদস্য কিংবা শাসকগোষ্ঠীর সদস্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সে সম্পদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে, তা মূলত নমুনা মাত্র। কারণ, যুক্তরাজ্যে আরও অনেকে সম্পদ রয়েছে, যেগুলোর প্রকৃত মালিক সম্পর্কে জানা যায় না।
জন হেথারশ বলেন, বিশ্বজুড়ে ধনী শাসক শ্রেণির জন্য লন্ডন একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। কারণ, এখানে বিভিন্ন দেশের মানুষের বসবাস এবং বাণিজ্য কেন্দ্র। এখানকার বিভিন্ন আইনি প্রতিষ্ঠান ওই ধনীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার নিশ্চয়তাও দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, কাজাখস্তানের শাসকদের জন্য লন্ডন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। কারণ, তারা ব্রিটিশ সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও প্রিন্স এন্ড্রুর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তখন কাজাখস্তানের শাসকদের পরামর্শ দিয়েছেন ব্লেয়ার। আর এন্ড্রু ভালো সম্পর্ক রেখেছিলেন দেশটির ধনীদের সঙ্গে।
২০০২ সালের পর কাজাখস্তানের শাসকগোষ্ঠীর স্বজনেরা যুক্তরাজ্যে সম্পদ ক্রয় করেননি, এমনটা নয়। ২০০৭ সালে বার্কশায়ারের প্রিন্স এন্ড্রুর বাড়ি কিনেছিলেন নুরসুলতান নাজারবায়েভের জামাতা তৈমুর কুলিবায়েভ। প্রায় দুই কোটি ডলারে এই বাড়ি কিনেছিলেন তিনি। এরপর ২০২০ সালে আবারও খবরের শিরোনাম হন নুরসুলতান নাজারবায়েভের পরিবারের সদস্যরা। ওই বছর লন্ডনে তাঁর মেয়ে দারিগা নাজারবায়েভ ও নাতি নুরালি আলিয়েভের সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ১১ কোটি ডলার।
অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং তা বিভিন্ন দেশে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে, এ নিয়ে একটি বই লিখেছেন অলিভার বুলফ। বইটির নাম ‘মানিল্যান্ড’। তিনি বলেন, সম্প্রতি কাজাখস্তানে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, এর পেছনে রয়েছে সম্পদ অবৈধভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে যাওয়া। কেপিএমজি প্রতিবেদন অনুসারে, ১৬২ জন দেশটির অর্ধেক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করেন।
অলিভার বুলফ বলেন, কাজাখস্তানের এই ব্যক্তিরা বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছেন। এর তুলনায় সাধারণ মানুষের আয় একেবারে সীমিত। আর এই অর্থ প্রথমে তারা লন্ডনে নেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালে যুক্তরাজ্যের প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা বেন কাউডক বলেন, যুক্তরাজ্যের উচিত এ নিয়ে তদন্ত করা। অবৈধ অর্থের সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায় কি না, তা নিয়েই তদন্ত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
২০১৯ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতা ছেড়েছেন নুরসুলতান নাজারবায়েভ। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়লেও ক্ষমতা ছাড়েননি। কারণ, তিনি সিকিউরিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। এই বিক্ষোভ শুরুর পর তাকে এই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এর পর থেকে তিনি কোথায় রয়েছেন, তা জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি দেশ ত্যাগ করেছেন। এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, যুক্তরাজ্যের বাইরে থেকে কারা দেশটিতে সম্পদ গড়েছেন, তা নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে।