বৈধ পথে ১৪ মাসে দেশে এসেছে ২১ হাজার কোটি টাকার সোনা
অর্থনীতি ডেস্ক : দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে গত ১৪ মাসে বৈধ পথেই প্রায় ৪২ টন (৩৬ লাখ ভরি) সোনার বার এসেছে। বর্তমান বাজার অনুযায়ী এই পরিমাণ সোনার দাম প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বাজারে দাম বেশি হওয়ায় সাধারণত যাত্রীরা বিদেশ থেকে সোনা নিয়ে আসেন। এছাড়া একটি পক্ষ বাহক হিসেবে দেশে সোনা নিয়ে আসার কাজ করে।
তিনটি বিমানবন্দরের তথ্যের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, যাত্রীদের আনা সোনার ৭০% আসছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। আর প্রতি ভরিতে দুই হাজার টাকা করে ১৪ মাসে সরকার শুল্ক পেয়েছে ৭১৪ কোটি টাকা। উল্লিখিত সময়ে দেশে বৈধভাবে যে সোনা এসেছে, তার দাম প্রায় দুটি পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণ ব্যয়ের সমান।
ই-কমার্স সাইট ঘেঁটে দেখা যায়, সংযুক্ত আরব-আমিরাতের দুবাইয়ে এখন ২২ ক্যারেট মানের এক ভরি সোনার দাম ৫৪ হাজার টাকার কিছু কম। বাংলাদেশে তা ৭৩ হাজার টাকার বেশি। ফলে গয়না নিয়ে আসা লাভজনক।
দুবাই প্রবাসী ও কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, দুবাই থেকে বৈধ পথে সোনা আসছে বেশি। এসব দেশে পাচারকারীর প্রতিনিধি বা এজেন্টরা বাংলাদেশগামী যাত্রীদের বারপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে দেয়, সঙ্গে শুল্কের টাকা। এভাবে বাহক হিসেবে কাজ করতে কোনো ঝক্কি নেই বলে যাত্রীরা সহজে রাজি হন। বিমানবন্দরে শুল্ক দিয়ে সোনা ছাড়ানোর পর যাত্রীদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করে পাচারকারীর প্রতিনিধিরা।
সোনা ব্যবসায়ী ও শুল্ক গোয়েন্দাদের মতে, এত সোনার চাহিদা বাংলাদেশে নেই। এই সোনার বড় অংশ বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলও বলছে, ভারতে অবৈধভাবে ঢোকা সোনার একটি অংশ যায় বাংলাদেশ থেকে। সংস্থাটি গত ৯ ডিসেম্বর “বুলিয়ন ট্রেড: ইন্ডিয়ান গোল্ড মার্কেট সিরিজ” শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ভারতে বছরে ১০০ টনের মতো সোনা অবৈধ পথে ঢোকে। যার উৎস বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, অবৈধ সোনা–বাণিজ্যের কয়েকটি নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে- এর মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়; আমদানি না করে বিদেশফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে সোনা এলে সরকার রাজস্ব কম পায়; অবৈধ সোনা–বাণিজ্যের সঙ্গে অস্ত্র, মাদক ও হুন্ডির যোগসূত্র থাকে; সোনার বদলে মুদ্রা এলে তা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়াতে ভূমিকা রাখত।
তবে বিদেশ থেকে ফেরার সময় একজন যাত্রী বিনা শুল্কে ১০০ গ্রাম বা সাড়ে আট ভরি পর্যন্ত সোনার গয়না আনতে পারেন। এই সোনার গয়না সাধারণত দেশের বাজারে কেনাবেচা হয়। তবে এই সোনার হিসাব নথিভুক্ত করা হয় না বিমানবন্দরে।
অন্যদিকে যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ বিধিমালা অনুযায়ী, একজন যাত্রী ২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি সোনার বার শুল্ককর পরিশোধ করে আনতে পারেন। এভাবে আনার ক্ষেত্রে ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুল্ক ভরিপ্রতি এক হাজার টাকা কমিয়ে দুই হাজার টাকা নির্ধারণ করে সরকার।
তিনটি বিমানবন্দরের কাস্টমসের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি সোনার বার আসছে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে। ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪ মাসে যাত্রীরা এই বিমানবন্দর দিয়ে ২৫ লাখ ৩৯ হাজার ভরির সমপরিমাণ সোনার বার এনেছেন। একই সময়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে আনা হয়েছে ১০ লাখ ২৬ হাজার ভরি সোনা। সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ছয় মাসের হিসাব পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, এই বিমানবন্দর দিয়ে এসেছে ৭ হাজার ২৮৭ ভরি সোনা।
যাত্রীরা মূলত দুটি কারণে সোনা নিয়ে আসেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ যাত্রীরা সোনা নিয়ে আসেন দেশে দাম বেশি বলে। দেশে এনে বিক্রি করলে তার লাভ হয়। দ্বিতীয় একটি পক্ষ আছে, যারা বাহক হিসেবে কাজ করেন। বিমানবন্দর দিয়ে বৈধভাবে একজন যাত্রী সর্বোচ্চ ২০ ভরি পরিমাণ সোনার বার শুল্ক দিয়ে আনতে পারেন।
গত ১৪ মাসের হিসাবে দেখা যায়, কমপক্ষে ১ লাখ ৭৮ হাজার যাত্রী সোনা এনেছেন। তবে একই যাত্রী বারবার সোনার বার এনেছেন, এমন ঘটনা উদঘাটন করেছে কাস্টমস। সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনটি বিমানবন্দরের কাস্টমসে ব্যবহার হওয়া “গুডস ম্যানেজমেন্ট” সফটওয়্যারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একজন যাত্রী তিন মাসে ২০ দফা সোনার বার এনেছেন। অবশ্য এতে কোনো আইনি বাধা নেই।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিয়ে সোনা পাচারের সময় পাচারকারীরা মাঝেমধ্যে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) হাতে ধরা পড়ে। বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে প্রায় প্রতি মাসেই সীমান্ত এলাকা থেকে সোনা জব্দ করা হয়েছে। সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসেই বিজিবি চারটি ঘটনায় ১৪ কেজি সোনার বার জব্দ করেছে। আগের ১১ মাসে পরিমাণ ছিল ৩৫ কেজি। এসব ঘটনায় ২৩ জন আটক হয়েছিল। তবে তারা ছিল মূলত বাহক।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে সোনার দ্বিতীয় বৃহত্তম ভোক্তা দেশ ভারত। দেশটি প্রতিবছর বৈধ পথে প্রায় সাড়ে ৭০০ টন সোনা আমদানি করে। ওই দেশে সোনা আমদানিতে মোট করভার ১০.৭৫%। দুবাই থেকে ভারতে সোনা আমদানিতে প্রতি ভরিতে কর দাঁড়াবে প্রায় ৫ হাজার ৮০০ টাকা। বাংলাদেশে ব্যাগেজ রুলের আওতায় আনা সোনার ওপর শুল্ক ভরিপ্রতি দুই হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশ দিয়ে বৈধভাবে এনে ভারতে পাচার সহজ। এ ছাড়া আমদানিতে শুল্ক ফাঁকি দিতে অনেকে পণ্যের মূল্য কম দেখান। মূল্য যতখানি কম দেখানো হয়, তা অবৈধ পথে পরিশোধ করা হয়। সহজে অবৈধ লেনদেনের জন্য সোনা ব্যবহারের আশঙ্কা থেকে যায়।
অন্যদিকে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মইনুল খান মনে করেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সোনা আমদানির শুল্কহারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা হলে পাচারের প্রবণতা কমতে পারে। বিদেশ থেকে আসা সোনা কোথায় গেল, সেটা গভীর অনুসন্ধানের বিষয়। যাত্রীদের নিয়ে আসা সোনা ব্যক্তিগত খাতে ব্যবহৃত হওয়ার কথা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “বৈধভাবে যে সোনা আসছে, দেখতে হবে তা দেশে থাকে কি না। যদি না থাকে, বৈধ হোক-অবৈধ হোক, প্রভাব একই খারাপ।” সূত্র : ঢাকাট্রিবিউন।