অতিমারীর সময়ে দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে : টিআইবি
মতিনুজ্জামান মিটু: কোভিড-১৯ অতিমারী বিশে^র অধিকাংশ দেশের মত বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এবং সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে এক অভূতপূর্ব সংকটে ফেলে। করোনার বিস্তার মোকাবেলার জন্য আরোপিত সাধারণ ছুটি এবং লকডাউন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা, ক্ষুদ্রঋণ কর্মকা-,সাধারণ কর্মজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষের কর্মসংস্থানসহ সার্বিকভাবে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা স্থবির ও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
বিগত সময়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ও মানবিক সহায়তায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। তবে করোনা সংকটের প্রাথমিক পর্যায়ে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সরকারি নীতিকৌশল ও কর্মপন্থার সঙ্গে কার্যকরভাবে যুক্ত না করার অভিযোগ ওঠে। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ‘করোনা সংকট মোকাবেলায় সাড়াদানকারী বেসরকারি সংস্থাসমূহের ভূমিকা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ টিআইবির প্রতিবেদনে এসব কথা তুলে ধরা হয়। গবেষণায় উপদেষ্টা ছিলেন; টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা প্রফেসর ড. সুমাইয়া খায়ের ও রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
উদ্ভূত এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি একদিকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক স্ব স্ব অবস্থান হতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়, অন্যদিকে করোনা সংকটের শুরুর দিকে বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) যথাযথ ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন মহল হতে প্রশ্ন ওঠে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সমালোচনামূলক মন্তব্য এবং অভিযোগও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। করোনা সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন খাত ও ইস্যুভিত্তিক গবেষণা পরিচালিত হলেও সুনির্দিষ্টভাবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণার অপ্রতুলতা রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে করোনা সংকট মোকাবেলায় বেসরকারি সংস্থার নেওয়া উদ্যোগ ও অবদানের ব্যাপ্তি এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও শুদ্ধাচার চর্চা পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে টিআইবি এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে।
গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য করোনা সংকট মোকাবেলায় সাড়াদানকারী বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জ পর্যালোচনা করা। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর সময়ে গবেষণার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। গবেষণার অংশ হিসেবে উপকারভোগীর জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ১ থেকে ১০ ডিসেম্বর ২০২০ এবং বেসরকারি সংস্থার জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ২৫ নভেম্বর হতে ২০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখের মধ্যে।
বেসরকারি সংস্থা নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুই পর্যায়বিশিষ্ট স্তরায়িত গুচ্ছ নমুনায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। প্রথম ধাপে সারা দেশ থেকে ৪৪টি জেলা নির্বাচন করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচিত জেলাগুলোতে কার্যক্রম পরিচালনকারী আন্তর্জাতিক, জাতীয় এবং স্থানীয় সংস্থাগুলোকে দৈবচয়নের মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়েছে। নির্বাচিত মোট ১১৭টি প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নপত্র পাঠান হয়। তার মধ্যে ৭৪টি প্রতিষ্ঠান তা পূরণ করে ফেরত পাঠায় যার মধ্যে ৯টি আন্তর্জাতিক, ২৩টি জাতীয় এবং ৪২টি স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান ছিল।
উপকারভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে টিআইবি পরিচালিত জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭ অনুযায়ী বেসরকারি সংস্থা হতে সেবাগ্রহণকারী ৬,২৮১ খানাকে এগবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাছাইকরা সর্বমোট ৭৫০ জন উপকারভোগীর মধ্যে চূড়ান্তভাবে ৫৮৯জন উপকারভোগী জরিপে অংশ নেন। উল্লেখ্য টেলিফোনের মাধ্যমে উপকারভোগীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯৭.৩ শতাংশ (৭২টি) সংস্থা সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক পরিধান করা, নিয়মিত ও সঠিক পদ্ধতিতে হাত ধোয়া, ‘লকডাউন’ ও হোম কোয়ারেন্টাইন মেনে চলা ইত্যাদি সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেয়। সামাজিক সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে এসব সংস্থা সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ, মাইকিং, পোস্টার ও ব্যানার টানানো ইত্যাদি কর্মকা-ের পাশাপাশি সঠিক নিয়মে হাত ধোয়া বিষয়ক প্রশিক্ষণ এবং নিরাপদ দূরত্ব মেনে চলা বিষয়ক ক্যাম্পেইনের মত কার্যক্রমেও সম্পৃক্ত হয়েছে। উল্লেখ্য, গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত উপকারভোগীদের ৪৬ শতাংশ (২৭০জন) বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নেওয়া সচেতনতা কার্যক্রমের আওতায় এসেছে যাদের মধ্যে ৭২.৫ শতাংশ উপকারভোগী এলাকায় মাইকিং-এর মাধ্যমে এবং ৪৯.১ শতাংশ উপকারভোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা পেয়েছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী সংস্থাগুলোর ৫৫.৪ শতাংশ খাদ্য ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। সংকট মোকাবেলায় কিছু কিছু বেসরকারি সংস্থা হতে খাদ্য সামগ্রী দেওয়ার পাশাপাশি ত্রাণ প্যাকেজও বিতরণ করা হয়েছে। সংস্থাগুলোর প্রায় ৮৩ শতাংশ ত্রাণসামগ্রী (প্যাকেজ) বিতরণ করে; ত্রাণ প্যাকেজের মধ্যে খাদ্য সামগ্রী, সুরক্ষা সামগ্রীসহ ক্ষেত্রবিশেষে নগদ অর্থও অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
জরিপে অংশগ্রহণকারী বেসরকারি সংস্থাসমূহের প্রায় ৩৬.৫ শতাংশ (২৭টি) করোনা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা দেয়। প্রায় ৮৩ শতাংশ (৬২টি) সংস্থাসুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করে। সুরক্ষা সামগ্রীর মধ্যেপিপিই, হ্যান্ড সেনিটাইজার, জীবাণুমুক্তকরণ কক্ষ ও হাত ধোয়ার পয়েন্ট স্থাপন উল্লেখযোগ্য। উদাহারণস্বরূপ, একটি আন্তর্জাতিক এনজিও এক কোটি ৩০ লাখ মাস্ক এবং ৩০ লাখ সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করে, অন্যদিকে একটি জাতীয় এনজিও চিকিৎসকদের জন্য ২ কোটি ৮৭ লক্ষ ৬০ হাজার ২০০ টাকা ব্যয়ে ২০ হাজার ৫৪৩ সেট ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) প্রদান করে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৫৬.৮ শতাংশ (৪২টি) প্রতিষ্ঠান করোনাকালে দুঃস্থ ও অসহায় মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা দেয়। ত্রাণ প্যাকেজের সঙ্গে একত্রে এবং পৃথকভাবে এই নগদ অর্থ দেয়। কিছু প্রতিষ্ঠান কর্মীদের ১ দিনের বেতন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করে। করোনা সংকটের শুরুর দিকে দুইটি এনজিও প্রায় ৬০ কোটি টাকা নগদ আর্থিক সহায়তা দেয়।
করোনাকালীন স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণার পাশাপাশি পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা ও দ্রুততার সঙ্গে সেগুলোর ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহারণস্বরূপ একটি প্রতিষ্ঠান করোনা বিষয়ক ১৬টি গবেষণার কাজ সম্পন্ন করে এবং ৩২টি গবেষণার কাজ বর্তমানে চলমান; তাদের ২২০ জন কর্মকর্তার বর্ধিত বেতন আর বোনাসের টাকা গবেষণার কাজে ব্যয় করে।
লাশ দাফন বা সৎকার: করোনার সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এবং করোনার লক্ষণ নিয়ে মৃতদের দাফন ও সৎকার অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯.৫ শতাংশ (৭টি) প্রতিষ্ঠান করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন ও সৎকারে ভূমিকা পালন করেছে। এসব সংস্থার মধ্যে আল মানহিল, আল মারকাজুল ইসলাম, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, রহমতে আলম সমাজসেবা সংস্থা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
করোনা অতিমারীর ফলে কর্মহীন প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স সংকট, অভিবাসন-প্রত্যাশী বা ছুটিতে থাকা প্রবাসীদের কর্মস্থলে যোগ দিতে না পারা, বিভিন্ন রাষ্ট্র হতে প্রবাসীদের ফেরত পাঠানোসহ বিভিন্ন সংকটে কিছু সংস্থা সহযোগিতামূলক কার্যক্রম নেয়। এসব কার্যক্রমগুলোর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসী ও তাদের পরিবারকে অর্থ সহায়তা, পুনর্বাসন করা, আইনি সহায়তা ও কাউন্সেলিং সেবা দেওয়া উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কিছু প্রতিষ্ঠান বিদেশ হতে প্রত্যাগতদের বকেয়া পাওনা পরিশোধের বিষয়ে অধিপরামর্শ কার্যক্রম গ্রহণ এবং কোয়রেন্টাইনের জন্য সরকারকে আবাসন কক্ষ দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অন্যান্য খাত বা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা তুলনামূলকভাবে অধিক কার্যকরভাবে প্রান্তিক ও নি¤œআয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঋণ বিতরণ করে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ৬৮ শতাংশ সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়ক অংশীজন হিসেবে কাজ করে যাদের মধ্যে ৯২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই সরকারের করোনাবিষয়ক সচেতনামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল।
করোনা সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে এই গবেষণা জরিপের অন্তর্ভুক্ত প্রায় দুই তৃতীয়াংশের বেশি সংস্থার তহবিলের মূল উৎস ছিল সাধারণ তহবিল (জেনারেল ফান্ড) ও তাদের চলমান প্রকল্প বা প্রকল্পগুলোর তহবিল।