মাছি নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি বাড়ছে গুণগত শুটকি উৎপাদন
মতিনুজ্জামান মিটু : এগিয়ে চলেছে বন্ধ্যা মাছি দিয়ে শুটকীর ক্ষতিকারক বন্য মাছি দমন কার্যক্রম। সোনাদিয়ায় ছাড়া হয়েছে ১৩ লাখ বন্ধ্যা মাছি। এবার গবেষণাগারে উৎপাদিত বন্ধ্যা মাছি দিয়েই দমন করা হচ্ছে শুটকীর জন্য ক্ষতিকারক বন্য মাছি। আর এ বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করেই মাছি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কক্সবাজারে শুটকীর উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। লক্ষ্য বাস্তবায়নে শহরের কলাতলীস্থ সৈকত খনিজ বালি আহরণ কেন্দ্রে প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয় একটি গবেষণাগার ও প্রযুক্তি কেন্দ্র।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের উদ্ভাবিত এই পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিবছর শুটকীর উৎপাদন প্রায় এক তৃতীয়াংশ বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান খাদ্য ও বিকিরণ জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বিকিরণ কীটতত্ত্ব ও মাকড়তত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. এ.টি.এম ফয়েজুল ইসলাম জানান, আমাদের গবেষণাগারে প্রতিবারে ২০ লাখ করে মাসে ২ বার ৪০ লাখ বন্ধ্যা মাছি উৎপাদন করা সম্ভব।
দেশে প্রতি বছর প্রায় ১২ লাখ টন (১.২ মিলিয়ন টন) সামুদ্রিক ও স্বাদু পানির মাছ উৎপাদিত হয়। যার মধ্যে প্রায় ১৫গশতাংশ মাছকে সূর্যের তাপে শুকিয়ে শুটকীতে রূপান্তর করা হয়। তবে মাছ রোদে শুকানোর সময় লিওসিনিয়া কাপ্রিয়া নামের এক প্রজাতির ক্ষতিকারক মাছির আক্রমণে প্রায় ৩০শতাংশ শুটকীই নষ্ট হয়ে যায়। এরমধ্যে দেশের বৃহত্তম শুটকী মহাল নাজিরারটেকেই নষ্ট হয়ে যায় বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার শুটকী। আর এই মাছির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য শুটকী উৎপাদকরা মাছে বিষ বা অতিরিক্ত লবণ দিচ্ছেন।
ফলে ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়েরই স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। আবার শুটকীৎর গুণগত মানও কমছে এবং উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এতে বাজার মূল্য কমে শুটকী মাছ বিদেশে রপ্তানী করা যাচ্ছে না। এসব বিবেচনা করে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন কমিশন বা মাছি বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে শুটকী মাছের ক্ষতিকর পোকা দমনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে বলে জানান পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান খাদ্য ও বিকিরণ জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বিকিরণ কীটতত্ত্ব ও মাকড়তত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. এ.টি.এম ফয়েজুল ইসলাম।
গবেষণাগারে উৎপাদিত বন্ধ্যা মাছি দিয়েই দমন করা হচ্ছে শুটকির জন্য ক্ষতিকারক বন্য মাছি। ক্ষতিকর মাছির উপদ্রব কমিয়ে কীটনাশকমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর শুটকি উৎপাদনের জন্য গত বছরের অক্টোবর থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে ছাড়া হয়েছে ১৩লাখ বন্ধ্যা মাছি। একই বছরের অক্টোবর মাসে সর্বপ্রথম ২ লাখ মাছি ছাড়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ দ্বীপের বন্ধ্যা মাছি’র কার্যক্রম। পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান খাদ্য ও বিকিরণ জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বিকিরণ কীটতত্ত্ব ও মাকড়তত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. এ.টি.এম ফয়েজুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী ২৮ ডিসম্বের সোনাদিয়া দ্বীপে ১০ লাখ বন্ধ্যা মাছি অবমুক্ত করেন।
স্থানীয় শুটকি উৎপাদকদের মতে, ২০০৭ সালেও সোনাদিয়া দ্বীপে ক্ষতিকর মাছির উপদ্রব কমাতে বন্ধ্যা মাছি ছাড়া হয়েছিল। এরপর ক্ষতিকর মাছির উপদ্রব একদম কমে যায় এবং শুটকির উৎপাদন ও গুণগত মানও বাড়ে। এসময় বন্ধ্যামাছি ছাড়ার কারণে সোনাদিয়া দ্বীপে কীটনাশকমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর শুটকি উৎপাদন করা সম্ভব হয়। এতে শুটকির মূল্যও পাওয়া যায় আগের চেয়ে দ্বিগুণ। ১৪ বছর পর নতুন করে বন্ধ্যামাছি ছাড়ায় এ মৌসুমে গুণগত মানের শুটকি উৎপাদন অনেক বাড়বে এবং উৎপাদকরাও বেশ লাভবান হবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষতিরকারক মাছির বংশ কমিয়ে শুটকির উৎপাদন ও গুণগত মান বাড়ানো সম্ভব। এই পদ্ধতিটি পরিবেশ বান্ধব, টেকসই, সহজ ও স্বাশ্রয়ী। এই পদ্ধতির মাধ্যমে বিষমুক্ত ও নিরাপদ শুটকি উৎপাদন সম্ভব হবে। যার দরুন দেশীয় বাজারে শুটকির চাহিদা বেড়ে যাবে। শুটকি উৎপাদনকারীরা চড়া বাজার মূল্য পাবেন। অন্যদিক এই বিষমুক্ত ও নিরাপদ শুটকি বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব।
ড. ফয়েজুল বলেন, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি হলো এক ধরনের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে কোন এলাকায় বন্য মাছির কয়েকগুণ বন্ধ্যামাছি ছাড়া হয়। এরপর বন্ধ্যা মাছির সঙ্গে ক্ষতিকর মাছির মেলামেশায় যে ডিম জন্ম হয়, তা থেকে আর বাচ্চা ফোটে না। এভাবে ধীরে ধীরে সেই মাছির বংশ কমে যায়। তবে ক্ষতিকর মাছির নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি দুই মাস অন্তর একবার করে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে বলে জানান তিনি।
বিজ্ঞানীরা জানান, সোনাদিয়া ও নাজিরারটেক শুটকি মহালে চার প্রজাতির মাছি দেখা যায়। এরমধ্যে মাত্র লিওসিনিয়া কাপ্রিনা প্রজাতির মাছিই শুটকিতে ডিম পেড়ে শুটকি নষ্ট করে দেয়। আর এই প্রজাতির মাছিটিকে বন্য পরিবেশ থেকে ধরে এনে গবেষণাগারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে গণ উৎপাদন করা হয়। ডিম থেকে শুককীট, এরপর পিপাসহ চারটি পর্যায় অতিক্রম করে মাছি পূর্ণ বয়স্কতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু পুরুষ মাছিগুলোকে তৃতীয় পর্যায়ে বা পিপা পর্যায়ে থাকা অবস্থায় গবেষণাগারে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ গামা ও এক্স-রে রশ্মির বিকিরণ প্রয়োগ করা হলে তারা বন্ধ্যা হয়ে যায়। কোন এলাকাকে ক্ষতিকর মাছি মুক্ত করার জন্য এই মাছির দ্বিগুণ বা তারও বেশি সংখ্যায় বন্ধ্যা মাছি ছেড়ে দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক উদ্ভিদ সংরক্ষণ কনভেনশনও এই বিকিরণ প্রয়োগ পদ্ধতিতে বন্ধ্যাকরা পোকামাকড়কে একটি লাভজনক প্রাণি এবং বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতিকে একটি দ্রুপধি প্রযুক্তি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যে পদ্ধতিতে অস্থানীয় বা বিজাতীয় পোকামাকড় ব্যবহার করা হয় না।
এই জৈব পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্যও ইতোমধ্যে দি স্পেশাল প্রোগ্রাম ফর রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং ইন ট্রপিকাল ডিজিজ(টিডিআর) নামের একটি প্রকল্পের অধীনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সি (আইএইএ) এর একটি চুক্তি সই হয়েছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে স্বাক্ষরিত ওই চুক্তির আওতায় বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতিতে এডিস মশার বংশ নিয়ন্ত্রণ করে চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ও জিকার প্রাদুর্ভাব কমিয়ে আনার আশা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সি (আইএইএ)।
এসআইটি বা বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষতিরকারক মাছির বংশ কমিয়ে শুটকীর উৎপাদন ও গুণগত মান বাড়ানো সম্ভব। এই পদ্ধতিটি পরিবেশ বান্ধব, টেকসই, সহজ ও স্বাশ্রয়ী। এপদ্ধতির মাধ্যমে বিষমুক্ত ও নিরাপদ শুটকী উৎপাদন সম্ভব হবে। দেশীয় বাজারে শুটকীর চাহিদা বেড়ে যাবে। শুটকী উৎপাদন কারীরা চড়া বাজার মূল্য পাবেন। অন্যদিক এই বিষমুক্ত ও নিরাপদ শুটকী মাছ বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ দমনের জন্য প্রায় ৭ দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্ভাবিত এই বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তি এসআইটি ব্যবহার হয়ে আসছে। এর আগে ১৯৯৮ সালে সোনাদিয়া দ্বীপে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শুটকী উৎপাদন বাড়ানোতে সাফল্য পাওয়া যায় বলে জানান এই বিকিরণ কীটতত্ত্ববিদ ড. এ.টি.এম ফয়েজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আগে কক্সবাজারে এই ইউনিট ছিল না। তাই ঢাকা থেকে কক্সবাজারে মাছি এনে তা সোনাদিয়ায় নিয়ে যাওয়া ছিল অনেক কষ্টসাধ্য বিষয়। এখন সরকার কক্সবাজারবাসীর জন্য প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি কেন্দ্র করে দিয়েছে। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে কক্সবাজারের শুটকী ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেই সরকারের প্রচেষ্টা সার্থক হবে।
কক্সবাজাররের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুত্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান বলেন, বিষমুক্ত অর্গানিক শুটকী উৎপাদনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বিএফআরআই’র বিজ্ঞানীরাও একটি মেকানিকেল টেকনিক উদ্ভাবন করেছে। যে টেকনিক ব্যবহার করে কয়েকটি ফ্যাক্টরী শুটকী উৎপাদন করে সাফল্য পেলেও এটি ব্যয়সাধ্য হওয়ায় এখনো শতভাগ খামারে ব্যবহৃত হচ্ছে না। তবে পরমাণু শক্তি কমিশন উদ্ভাবিত এই জৈব প্রযুক্তি দিয়ে সহজে মাছি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলে কক্সবাজারে শুটকী উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি মাইল ফলক হয়ে থাকবে। ড. শফিকুর রহমান বলেন, ৯ : ১ হারে বন্ধ্যা মাছি অবমুক্ত করলে কার্যকর ফল পাওয়া যায়।