খুলনায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ঘেরের পাড়ে টমেটো চাষ
মতিনুজ্জামান মিটু : খুলনার বিভিন্ন উপজেলার মাছের ঘেরের পাড়ের জমিতে থোকায় থোকায় ঝুলছে কাঁচা পাকা টমেটো। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় টমেটোর বাম্পার ফলন হয়েছে এবং বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসির ঝিলিক। ক্ষেত থেকে টমেটো তুলে এনে স্থানীয় আড়তে ব্যবসায়ীদের কাছে ন্যায্যমূল্যে টমেটো বিক্রি করতে পেরে কৃষকরা অনেক খুশি।
খুলনার রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসের উপসহকারী কৃষি অফিসার মো. আবদুর রহমান জানান, রূপসা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মৎস্য ঘেরের পাড়ের জমিতে এবছর ব্যাপক টমেটো চাষ হয়েছে। জেলার রূপসা উপজেলার আনন্দনগর গ্রামে চাষি জুম্মান লস্কর নামের কৃষক এবছর মৎস্য ঘেরের পাড়ে দেড় বিঘা জমিতে মিন্টু সুপার নামক হাইব্রিড জাতের টমেটো চাষ করে। এতে বীজ, সার, মাদা তৈরি, শ্রমিক ও কীটনাশক বাবদ প্রায় ৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ইতোমধ্যে তিনি ৫০ মণ টমেটো প্রতি মণ এক হাজার টাকা দরে স্থানীয় আড়তে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। আরও প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার টমেটো বিক্রি করতে পারবে তিনি আশা করছেন।
এ উপজেলার পুটিমারি গ্রামের কৃষক কাজী রফিকুল ইসলাম জানান, ঘেরের পাড়ে এক বিঘা জমিতে বিপুল প্লাস জাতের টমেটো চাষ করতে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে ; ৮শ’ টাকা মণ দরে এপর্যন্ত ২০ মণ টমেটো ১৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। এরকম দাম থাকলে আরও ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার টমেটো বিক্রি করতে পারবো বলে মনে করছি। রফিকুল ইসলাম আরও জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার টমেটোর ফলন ভালো হয়েছে এবং দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। কৃষকেরা বলেন, রূপসা উপজেলার আলাইপুর ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আবদুর রহমান শসা চাষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন ।
জুম্মান লস্কর ও রফিকুল ইসলাম ছাড়াও আনন্দনগর গ্রামের নূরু শেখ, চাঁন মিয়া, নাসিম মোল্লা, হামজা মোল্লা, শাহীন শেখ, মুরাদ লস্কর, শানু লস্কর, হামিদুল বিশ্বাস, জিল্লুর লস্কর, তোহা লস্কর, হেলাল, সাগর খান, কালাম শেখ, ইছা শেখ, রসুল শেখ, ছাত্তার মোল্যা, আজহারুল ইসলাম, হাফিজ মোল্যা, আসাদ ও ফারুক মোল্যাসহ প্রায় দু’শতাধিক কৃষক মাছের ঘেরের পাড়ে হাইব্রিড জাতের টমেটো চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। কৃষকরা জানান, টমেটো একটি লাভজনক ও অর্থকরী সবজি। বর্তমানে এদেশে হাইব্রিড জাতের অনেক টমেটো চাষ হয়ে থাকে।
এ জাতের টমেটোর ফলন অনেক বেশি। এটি স্বল্প সময়ের সবজি। জাতভেদে চারা রোপণের ৫০ থেকে ৬০ দিন পর থেকেই ফল তোলা যায়। ধানের তুলনায় টমেটো চাষে ২ বা ৩ গুণ লাভ হয়। অল্প পুঁজিতে লাভ বেশি হওয়ায় মৎস্য ঘেরের পাড়ে টমেটো চাষ এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এলাকার কৃষকরা আরও বলেন, বসতবাড়ি কিংবা মাঠের চেয়ে ঘেরের পাড়ে টমেটো চাষ করে অধিক ফলন পাওয়া যায়। অন্য ফসলের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লাভ হওয়ায় মৎস্য ঘেরের পাড়ে টমেটো চাষে ঝুঁকে পড়েছেন কৃষকেরা। ঘেরে শুধুমাত্র মাছ ও ধান চাষ করে একসময় যাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটত, ঘেরের পাড়ে টমেটো ও অন্যান্য শাকসবজি চাষে এখন তাদের মুখে হাসি ফুটেছে।
রূপসা কৃষি অফিসের সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলার দুর্জ্জনীমহল, ডোমরা, চন্দনশ্রী, ভবানীপুর, পেয়ারা, জাবুসা, আমদাবাদ, দেবীপুর, নৈহাটী, সামন্তসেনা, তিলক, খাজাডাঙ্গা, স্বল্পবাহিরদিয়া, আলাইপুর, পুটিমারি, আনন্দনগর, পিঠাভোগ, গোয়ালবাড়িরচর, সিঁন্দুরডাঙ্গা, নারিকেলী চাঁদপুর, ডোবা, বলটি, নতুনদিয়া, ধোপাখোলা, গোয়াড়া, শিয়ালী, চাঁদপুর ও বামনডাঙ্গা গ্রামের মাছের ঘেরের পাড়ে প্রায় ২৫০ হেক্টর জমিতে এবছর টমেটো চাষ হয়েছে। তবে ঘাটভোগ ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে সবচেয়ে বেশি জমিতে টমেটো চাষ হয়েছে। ঘেরের পাড়ে টমেটো চাষ করে কম সময়ে অধিক ফলন ও ভালো দাম পেয়ে এসব গ্রামের কৃষকরা দারুণ খুশি।
ঘেরের পাড়ে উৎপাদিত টমেটো কেনা-বেচার জন্য গ্রামে গ্রামে গড়ে গড়ে উঠেছে টমেটোর মওসুমি আড়ত। স্থানীয়ভাবে এ আড়তকে ‘গালা’ বলা হয়। তাই টমেটো বিক্রি করতে সাধারণত পরিবহন খরচ লাগে না। কৃষকেরা ক্ষেত থেকে টমেটো তুলে এনে আড়তে বিক্রি ্করেন। টমেটো চাষে মহিলা ও বেকার যুবকসহ স্কুল-কলেজের ছাত্রদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে ট্রাকযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যাচ্ছে এখানকার টমেটো। স্থানীয় বাজারের ক্রেতারা টাটকা ও তাজা টমেটো কিনতে পেরে খুশি।
রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসার মো. ফরিদুজ্জামান বলেন, অন্যান্য ফসলের তুলনায় মাছের ঘেরের পাড়ে টমেটো চাষ লাভজনক হওয়ায় এ উপজেলায় দিন দিন টমেটো চাষ বাড়ছে। ঘেরের পাড়ে কম খরচে টমেটো চাষ করে লাভবান হওয়ার জন্য এ উপজেলার প্রতিটি ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা চাষিদের পাশে থেকে সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। এছাড়া উপজেলা কৃষি অফিস থেকে এসব কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এবছর কৃষকেরা ঘেরের পাড়ে টমেটো চাষ করে আশাতীত ফলন পেয়ে লাভবান হয়েছেন। এতে কৃষকের মধ্যে ঘেরের পাড়ে টমেটো চাষে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। তারা আগামীতে মাছের ঘেরের পাড়ে আরও বেশি করে টমেটো চাষ করবেন বলে আশা করেছেন। রূপসার মতো ডুমুরিয়াসহ খুলনার অন্যান্য উপজেলার মাছের ঘেরের পাড়েও ব্যাপকভাবে ফলেছে টমেটো।