আবারও আশা জাগাচ্ছে নীল চাষ
মতিনুজ্জামান মিটু : কথায় বলে জাত মাছে পাদরি ধরে, ভাত মাছে নীল বাঁদরে। বড় কষ্ট নিয়ে ছড়াটা বানিয়েছিল নীল চাষিরা। এছড়া শোনানো সে দীনবন্ধু মিত্রও আর নেই, নেই নীল বাঁদরেরাও। ভারতজুড়ে চাষিদের বিদ্রোহের মুখে নীলকর সাহেবের ল্যাজ গুটিয়েছিল প্রায় ১৫০ বছর আগে। এরপর ধীরে ধীরে ইতিহাসের ঘৃণিত অংশ হয়ে গেছে খোদ ব্রিটিশ শাসকেরাই। ধুলোর নিচে চাপা পড়ে গেছে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার। স্মৃতির চাদরের ভাজে ভাজে জমা হয়েছে কষ্টকথা। বাংলা থেকে নীল চাষও কি হারিয়ে গেছে? না আবার ফিরে এসেছে নীল, নীল, নীল চাষ। আবার বাংলাদেশের জমিতে নীলগাছ লক লক করে উঠে জানান দিচ্ছে নীল আছে আজও। কিন্তু এবার আর এ চাষের পেছনে হাত নেই নীল বাঁদরদের। এবার আর কারও পিঠে শ্যামচাঁদের বাড়ি দিয়ে চাষ করানো হচ্ছে না। মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গে আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে নীল চাষ। ক’বছর আগে শুরু হওয়া নীল চাষ নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে গরিব কৃষককে। এরাই নীলগাছের নাম দিয়েছে মাল গাছ। সারা পৃথিবীতেই এখন প্রাকৃতিক রংয়ের কদর অনেক বেশি। রাসায়নিক রংয়ের পারিবেশ বিনষ্টকারী প্রভাব সম্পর্কে পরিবেশবিদেরা এখন সরব।
ফলে তৈরি হচ্ছে ট্রু বেঙ্গল ইন্ডিগোর মতো প্রাকৃতিক রঙের চাহিদা। জরিপ বলে শুধু ভারতেই প্রতি বছর দরকার হয় ৩০০ টন নীলের। সবচেয়ে ভালো নীলের প্রতি কেজি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ২৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দুনিয়াজুড়ে নীলের মূল বেশির ভাগ চাহিদা মিটিয়ে আসছে এল সালভাদর। কিন্তু উত্তরবঙ্গের চাষিরা স্বপ্ন দেখছেন তাদের উৎপাদন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে যাবে দেশের আয় হবে। তারা আন্তর্জাতিক বাজারে গর্বিত বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন যে কোন দেশের। রংপুরের সদর উপজেলা, পাগলান্দীর, কিশোরগঞ্জ ও জলঢাকার ব্যাপক এলাকায় কৃষক আগে থেকেই মাল বা নীলের চাষ করতেন।
উদ্দেশ্য রং তৈরি নয়। জমিতে উর্বরতা বাড়ানো আর গাছগুলো শুকিয়ে জ্বালানির প্রয়োজন মেটানোর জন্য। ক’বছর আগে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এমসিসির উদ্যোগে রং তৈরির জন্য নীল চাষ শুরু হয়। বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। রংপুরে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার কেজির বেশি প্রাকৃতিক নীল উৎপাদিত হচ্ছে যা দেশে চাহিদার বড় অংশ পূরণের পর বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে আবার ফিরে আসা নীল চাষ এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছে হতদরিদ্র মঞ্জুরানী, বিমলা, কৃষ্ণা, মিথিলা, রাখাল, তৈমুর, মেহেদী, আরজু বা বুলু মিয়ার মতো লোকদের। এ মানুষই আগে জুলাই-আগস্টে মঙ্গার প্রস্তুতি নিতেন কষ্টজাগানিয়া রাত পোহানোর জন্য। আর সে সময়ের কষ্টের রাত পোহানোর পর এখন এ এলাকার মানুষগুলো ব্যস্ত নিজেদের নীল উৎপাদন প্রক্রিয়া চালানোর কাজে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক ও কৃষি তথ্য সার্ভিসের সাবেক পরিচালক কৃষি অর্থনীতিবিদ এবং কৃষিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আরও জানান, ১৮৪৭ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিশ্ববাজারে নীলের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়লেও চাষি ও কৃষক ন্যায্যমূল্য পেতো না। কারণ তাদের ক্রেতা ছিল একমাত্র নীলকর ইংরেজ। এ সময় ভাটির বাংলার প্রায় অর্ধেক নীল উৎপাদিত হতো বঙ্গদেশের নদীয়া ও যশোর জেলায়। প্রাণভয়ে কৃষক নীল চাষ করত কিন্তু তাতে অন্য যে কোনো ফসলের তুলনায় তাদের তৎকালীন ৭ টাকা ক্ষতি হতো। এছাড়া কুঠির কর্মচারী, নীলকরদের সঙ্গে বিক্রির মধ্যস্থতাকারী চামচাদের ঘুষ ছিল অতিরিক্ত সাধ্যাতিত। আর যদি মামলায় পড়ে যেত তবে আর রক্ষে নেই আরও বড় অংকের খরচ হয়রানি কষ্টযন্ত্রণা। ব্রিটিশ বেনিয়ারা এদেশের কৃষকদের আবাদি ফসল ফলানো বাদ রেখে নিজেদের লাভের জন্য সুন্দর চাকচিক্যের বিলাসিতার জন্য জোর করে নীল চাষ করাত। নীল চাষ না করলে তাদেরকে কঠোর অত্যাচার আর অমানসিক নির্যাতন করত। সে কষ্টের ইতিহাস এখনও বয়ে বেড়ায় বাংলার কিছু মানুষ মননে মেধায় স্মৃতিতে বৃতিতে।
যদিও দেশের কোথাও আজ নীলকর সাহেবদের পাওয়া যাবে না, তথাপি রংপুর জেলায় বিভিন্ন এলাকায় নীল চাষের দেখা পাওয়া যায় ভিন্ন আঙ্গিকে। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পরও বহু বছর ধরে বংশপরম্পরায় চাষ হয়ে আসছে নীল। অনুর্বর জমিকে উর্বর করতে ও জ্বালানি সংস্থান আর জৈবসার তৈরির জন্য স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘মাল’ গাছ বালুময় অনুর্বর পতিত জমি যেখানে সাধারণত কোন ফসল হতে চায় না এবং রাস্তার ধারের ফাঁকা জায়গায় লাগানো হয়। অনেকটা রাস্তার পাশের অড়হর গাছ লাগানোর মতো। এ মাল গাছই যে নীলের গাছ তা অনেকেই জানতও না। প্রায় ১৫০ বছরের কষ্টের পরিক্রমা। ১৮৫৯ সনে নীল চাষিদের বিদ্রোহ এখনও জগৎ নাড়া দেওয়ার মতো অনুভূতি জাগায় আজো প্রাণের অলিন্দে।
এদেশের মানুষদের পূর্বপুরুষদের কষ্টগাথা নিয়ে কত কাব্যকথা প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৫ সন সর্বপ্রথম জানা যায়, এ গাছ থেকে প্রাকৃতিক নীল সংগ্রহ করা যায়। আর আধাবাণিজ্যিকভাবে নীল উৎপাদন শুরু হয় ২০০৭ সনে রংপুর সদরের হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রামের ডা. অনীল কুমার রায়ের ছেলে ডা. নিখিল চন্দ্র রায়ের হাত ধরে। রংপুর জেলার সদর, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া ও নীলফামারী জেলা কিশোরগঞ্জ উপজেলা প্রায় ১০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১৩ হাজার কৃষক নীল চাষ করছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। ৩ বা ৪ বছর আগেও প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হতো। মাঝে নীল উৎপাদনকারী কারখানা বন্ধ থাকায় এর আবাদ কমে যায়। বন্ধ কারখানা চালু হওয়ায় এখন নীল চাষে নতুন উদ্যোম সৃষ্টি ও গতি সঞ্চার হয়েছে।
তাদের মধ্যে কেউ নীলগাছ চাষ করছেন কেউ পাতা সংগ্রহ করছেন আবার কেউ ব্যস্ত সে পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণে। লাভ শুধু নীল উৎপাদন করেই নয় কেন্দ্র থেকে যে নাইট্রোজেন ভরপুর বর্জ্য বেরিয়ে আসছে তা আবার ড্রামে ড্রামে চলে যাচ্ছে ফসলের মাঠে সোনালি ফসলের বাহারি ফলনের জন্য। কৃষক তা ব্যবহার করছে ইউরিয়া সারের বিকল্প পরিবেশবান্ধব জৈবসার হিসেবে। জমির মালিকেরা খুশি, চাষি খুশি, খুশি সবাই। খুশি নিজেদের তৈরি রঙ দিয়ে কাপড় রাঙানোয় যারা ব্যস্ত তারাও। রঙিন সে কাপড় চলে যাচ্ছে দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে বহুমাত্রিক কাজের জন্য। তৈরি হচ্ছে কাঁথা, শাল ও স্কার্ফ। ইতিহাসের কী অপূর্ব পরিহাস এবং তার উল্লেখযোগ্য পুনরাবৃত্তি। যে নীল একদিন তাদের পেটের ভাত কেড়ে নিয়েছিল আজ সে নীল ফিরে এসেছে মঙ্গা তাড়িয়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ সুখের নহর বইয়ে দিতে।
নীলের রয়েছে বহুমাত্রিক ব্যবহার। নীল সাধারণত সব ধরনের সুতি উলেন সিল্ক টাইপের জামা কাপড়ের রঙ উজ্জ্বল ঝকঝকে চকচকে করার জন্য ব্যবহার করা হয়। একজোড়া জামাকাপড় নীল দিতে ৩ থেকে ৭ গ্রাম নীলের প্রয়োজন হয়। সাধারণ হিসাবে জানা যায়, বছরে ২ মিলিয়ন কিলোগ্রাম নীল উৎপাদিত হয়। দেশের যে কোনো অনাবাদি পতিত জমিতে অনায়াসে নীল চাষ করা যায়। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনাবাদি পতিত অনুর্বর জমি পরিকল্পিতভাবে নীল চাষের আওতায় আনতে পারলে অভাবনীয় সফলতা আসতে পারে ঐতিহাসিক এ নীল চাষে দেশের কৃষির বিশেষ সমৃদ্ধিতে। নীলের ব্যবহার শুধু নীল হিসেবেই নয়। নীলগাছ উৎকৃষ্ট জ্বালানি এবং জৈবসার। তাছাড়া নীল দেওয়া জামা কাপড় পরলে বাতাসে ভাসমান বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া থেকে শরীরমুক্ত রাখা যায় এবং এলার্জি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। নীল চাষে পতিত অনাবাদি অনুর্বর জমি অর্থনৈতিক মূল্যে ব্যবহার করা যায়। নতুন ও বিশেষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়, উত্তরাঞ্চলের ফসলভিত্তিক সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
নীল তামাকের সুবিকল্প প্রতিযোগিতামূলক ফসল হিসেবে অনায়াসে আবাদ করা যায়। নীল তেল ব্যবহার করে ব্যাকটেরিয়াজনিত সমস্যা থেকে শতভাগ রক্ষ পাওয়া যায়। ১ দিনের শিশু থেকে শতায়ু বছরের বয়স্কদের শরীরে অনায়াসে নীলতেল ব্যবহার করে শরীর ভালো রাখে। ডাইং ও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে বেশ আবশ্যকীয় উপকরণ হিসেবে নীল ব্যবহার আবশ্যকীয় অংশ। ইদানীং চুলে কলপ দেওয়ার জন্য বেশ আয়েশিভাবে ব্যবহার বাড়ছে নীলের। নীল ব্যবহারে চামড়া ভালো থাকে, শরীরের উজ্জ্বলতা বাড়ে। নীল তেলের খৈল লোসন হিসেবে, সেভিং ফোম হিসেবে ব্যবহার দীর্ঘদিনের। দেহের ব্যথা উপশমে নীল ব্যবহৃত হয়। কেনিয়ার জনগণ নীলের ডাল দিয়ে দাঁত মাজেন দাঁতের রোগ থেকে উপশম পাওয়ার জন্য। কেউ কেউ পোকার আক্রমণ ও সাপের কামড়ে ব্যথায় বিষ কমানোর জন্য নীল ব্যবহার করেন। নীলের ওষুধ শিল্পে ব্যবহার রয়েছে বহুমাত্রিক। নীল গাছে কোনো সার দিতে হয় না।
পোকা রোগে আক্রমণ তেমন করে না। বলতে গেলে কোনো যতœআত্তি করতে হয় না। গরু ছাগল হাঁস-মুরগি খায় না নষ্ট করে না। নীলের পরাগ রেণু মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসে শারীরিক গঠনে সহায়তা করে। নীল তামাকের শতভাগ বিকল্প চাষ হতে পারে লাভ, পরিবেশ আর সার্বিকতা চিন্তা করে।
নীল কে প্রাকৃতিক নীলও বলা হয়। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে নীল সাধারণত মৌসুমি গাছ ৬ মাসের জীবনকাল বিশিষ্ট বৃক্ষ নয় তবে আধা শক্ত গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে বীজ বপন করলে অক্টোবর নভেম্বরে গাছ মারা যায়। বর্ষায় পাতা ঝরে যায়। ১ থেকে ২ মিটার লম্বা ঝোপালো গাছ হয়। পাতা ওভাল গোল ও সমান্তরালভাবে সন্নিবেশিত। ফুল গোলাপি থেকে বেগুনি রঙের হয়। মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়াতে এটা আচ্ছাদন ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। অনুর্বর জমিতে অনাদরেই বেড়ে ওঠে নীল কষ্টের নীলকণ্ঠ। নীলের অন্তত ৭৫০টি প্রজাতি আছে বিশ্বময়। নীলগাছ উষ্ণ ও অবউষ্ণ অঞ্চলে বেশি জন্মে। বিভিন্ন রকমের ফুল হয়। তবে লাল রঙের একটু ছায়া থাকে লালচে। তবে কিছু কিছু জাতের ফুল সাদা ও হলুদ রঙের। ফল ও বীজ সরিষার মতো। তবে জাতভেদে বিভিন্ন আকারের হয়। নীল বানানোর জন্য দুটো জাত বেশি উপযোগী। পৃথিবীর কোনো কোন দেশে নীল তাদের দ্বিতীয় অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিগণিত।
ফেব্রুয়ারি-মার্চ মূলত বীজ বপনের মূল সময়। অর্থাৎ এদেশে যখন পাট বপন করে তখনই নীলের বীজ বোনার সময় হয়। এক চাষ দিয়ে বীজ বপন করা হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিনা চাষেই বীজ বপন করা হয়। প্রতি একরে ৪ থেকে ৫ কেজি আর হেক্টরে ১০ থেকে ১৫ কেজির বীজের প্রয়োজন হয়। নীলের বীজ অনেকটা সরিষার বীজের মতো। ছিটিয়ে বপন করা হয় অনেকটা ধইঞ্চা বা পাটের বীজে মতো।
পাতা কাটা ও প্রক্রিয়জাতকরণ প্রসঙ্গে একৃষিবিদ জানান, বীজ বপনের ৯০ দিন পর গাছ যখন একটু বড় হয় তখন প্রথমবার পাতা কাটা হয়। ওপর থেকে ১ দেড় ফুট শাখাসহ পাতা কেটে আনা হয়। এভাবে ১ বার কাটার পর ৬ মাস আয়ুকাল মৌসুমে অন্তত ৪-৫ বার পাতা কাটা যায়। পাতা সংগ্রহের পরও গাছের অবশিষ্ট অংশ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বীজের গাছ থেকে নিয়মিত পাতা সংগ্রহ করা হয় না। প্রথমবার পাতা কাটার পর বীজ গাছকে আলাদা করে যতœআত্তি করে রাখা হয় বীজ সংগ্রহের জন্য। নীল সংগ্রহ কোনো বিশেষায়িত পদ্ধতি নয়। জমি থেকে গাছের উপরের শাখাসহ নীল পাতা সংগ্রহ করে চৌবাচ্চাতে পরিমাণমতো পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয় বা জাগ দেওয়া হয়। পানি এ পরিমাণে হবে যেন পাতার উপর ১ ইঞ্চি পানি থাকে। এভাবে ২০ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টা জাগে ডুবিয়ে রাখা হয়। এরপর প্রথম চৌবাচ্চা থেকে পাতা ডালপালা ছেকে শুধু নীল পানি দ্বিতীয় চৌবাচ্চাতে নেওয়া হয়। পাতা ডালপালা জৈবসার কিংবা জ্বালানি হিসেবে শুকিয়ে নেওয়া হয় বা জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় চৌবাচ্চা থেকে ১ ঘণ্টা ঝাঁকানির পর প্রচুর ফেনা সৃষ্টি হয়। বর্তমানে অটোমেটিক পদ্ধতিতে পানি নাড়াচাড়া করা হচ্ছে। এরপর পরিমাণমতো কস্টিক সোডা (গোপন ফরমুলা) মিশিয়ে আবার অনবরত নাড়াচাড়া বা ঝাঁকানো হয়। কতক্ষণ পর পুরো দ্রবণকে মাঝারি আকারের ঝুড়ি নিয়ে তারমধ্যে মোটা মার্কিন কাপড় বিছিয়ে দিয়ে ছাকার জন্য ফেনাযুক্ত ঝাঁকানো দ্রবণ ঢালা হয় এবং ১ দিনের জন্য রেখে দেওয়া হয়।
এতে মার্কিন কাপড়ে তলানি জমা হয় আর থিতানো পানি আলাদা হয়ে যায়। মার্কিন কাপড়ের এ তলানিই নীল। ছাকা পানি গাছের গোড়ায় দেয়া হয় বা বাথরুম মেঝে পরিষ্কার করতে কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়। এ পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলে পা ফাটা বা পায়ের বিভিন্ন চর্মরোগ সংক্রান্ত সমস্যা দূর হয়। পানি ঝরে যাওয়ার পর মার্কিন কাপড় থেকে ছোট চামচের মাধ্যমে কাঁচিয়ে সংগ্রহ করা হয়। এ সেমিসলিড ভেজা শক্ত অংশ নীল রোদে শুকিয়ে দানাদার নীল তৈরি হয়। প্রথমে রোদে শুকালে নরম কয়লার মতো হয়। ১ থেকে ২ দিন শুকালেই নীল শক্ত হয়। পরে গ্রাইন্ডিং মেশিনে বা হলারে বা পাটাপুতাতে পিশে গুঁড়া করে প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করা হয়। সাধারণভাবে প্রতি প্যাকেট নীলের দাম আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে কৌশল আর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে এ দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাবে, লাভও বেশি হবে। অনেক সময় ছোট ছোট আস্ত টুকরা করে ৫ টাকা করে বিক্রি করা হয়।
প্রতিবারে প্রতি শতক জমি থেকে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি পাতা সংগ্রহ করা যায়। প্রতি ১ একর জমি থেকে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার কেজি পাতা কাটা যায়। প্রতি কেজি পাতা মূল্য ২ থেকে ৩ টাকা হারে বিক্রি হয়। প্রতি একর থেকে ৫০ হাজার টাকার শুধু নীলপাতা বিক্রি করা যায়। তাছাড়া জ্বালানি এবং জৈবসার তো আছেই। এ পদ্ধতিতে ২০০ থেকে ২৫০ কেজি পাতা থেকে ১ কেজি নীল পাওয়া যায়। ১ কেজি নীল পেতে ১ হাজার টাকা খরচ হয়। বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি প্রাকৃতিক নীল প্রায় ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো ১০০ ভাগ বিশুদ্ধ মানসম্মত হতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ের সংগ্রহ পদ্ধতিতে প্রায় ১০ ভাগ নীল পাওয়া যায়। এ কারণে অনেক দেশে প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও রপ্তানি করা যাচ্ছে না। নীলের বীজ থেকে নীল তেল তৈরি করা যায়। ১০ মিলিলিটার তেল ৩০ মার্কিন ডলার। ৫ কেজি বীজ থেকে ১ কেজি তেল পাওয়া যায়। বীজের মূল্য ১৫০ টাকা ২০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি কেজি। নীল চাষে আর উৎপাদন খরচ নেই বললেই চলে। কেননা এটা অনুর্বর জমিতে আবাদ করা হয় জমি উর্বর করার জন্য। তাই কোনো সার পানি বালাইনাশক দেওয়ার দরকার হয় না। শুধু শ্রমিক মজুরি লাগে। সর্বসাকুল্যে ১ একরে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়।
কৃষি অর্থনীতিবিদ এবং কৃষিবিদ ড. জাহাঙ্গীর জানান, ডা. নিখিলের নীল চাষে বর্তমান প্রতিশ্রুত সমৃদ্ধির অগ্রপথিক। একা একাই এগোনোর চেষ্টা করছেন। তাকে যথাযথ সহযোগিতা করতে পারলে আমরা নীল নিয়ে আরো অনেক দূরে এগিয়ে যেতে পারতাম। তিনি মনে করেন নীলে এত বৈশিষ্ট্যের কার্যকারিতার পরেও নীলগাছ দিয়ে জাক দেওয়ার পর বাছাই করা ডালপালা থেকে উৎকৃষ্ট মানের কম্পোস্ট সার তৈরি; পাতা সংগ্রহের পর গাছের অবশিষ্টাংশ থেকে কয়েল তৈরি এবং নিজের তৈরি বন্ধু চুলাতে ব্যবহার; ছাকনির সময় ফেলে দেওয়া পানি মিনি প্যাকেটজাত করে ক্লিনার লিকুইড হিসেবে বাজারে বিক্রি করা যায়। নীল ঐতিহাসিকভাবে নীলকণ্ঠ নীলকষ্ট অনেক কষ্টগাথা কথা। কিন্তু রংপুরের ডা. নিখিল এ কষ্টগাঁথাকে সুখ গাঁথায় পরিণত করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিছুটা এগোতে পেরেছেনও।
এবিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. দেবাশীষ সরকার বলেন, নীল চাষ নিয়ে এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এখনও কোন কার্যক্রম নেই। চুয়াডাঙ্গা ও রংপুর জেলার সদও উপজেলার কোথাও কোথাও সীমিতভাবে নীলের চাষ হয়। এখন থেকে এ চাষের লাভ ক্ষতি সম্পর্কে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, রংপুরের সদর উপজেলার পাগলা পীরে কিছু কিছু পতিত জমিতে নীল চাষ হয়ে থাকে। নীল প্রক্রিয়াকরণের কয়েকটি কারখানাও আছে এখানে। ধইঞ্চার মতো দেখতে হয় নীল গাছ। সর্বোচ্চ ৩ মাসের ফসল এটি। মার্চ এপ্রিল মাসে নীল বীজ বপন করা যায়। তবে এফসলের লাভ ক্ষতি নিয়ে ব্যাপকভাবে জানার সুযোগ হয়নি। ফসলটিকে ঘিরে দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন কাজও নেই।