ড. জাফর ইকবালের হাতে ১৬৩ ঘণ্টা পর অনশন ভাঙলেন শিক্ষার্থীরা
জহিরুল ইসলাম : আন্দোলনের ১৩ম দিনে ও অনশনের দীর্ঘ ১৬৩ ঘণ্টা পর অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের হাতে অনশন ভেঙেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) আন্দোলনরত ২৮ শিক্ষার্থী।
বুধবার সকালে সস্ত্রীক ক্যাম্পাসে এসে পানি পান করিয়ে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ ৭ দিনের অনশন ভাঙান শাবিপ্রবির এই সাবেক শিক্ষক।
এসময় জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘যে মানুষ এসব দেখেও নিজের জায়গায় অনড় থাকে, তাকে আমি মানুষ বলতে চাই না, সে দানব। ঐ মানুষের জন্য তোমাদের জীবন যাওয়ার কোন মানেই হয় না। তোমাদের জীবন অনেক মূল্যবান।’
‘আমি এখানে আসতে চাইছিলাম না। কারণ তোমরা আমরা কথা না শুনলে তাই! তবে আমার ছেলে-মেয়েদের ওপর বিশ্বাস ছিল, তাই এসেছি। আমি সংকল্প করে এসেছি তোমাদের অনশন ভাঙিয়ে তারপর আমি সিলেট ছাড়ব। আমি চাই তোমরা আন্দোলন চালিয়ে যাও, তবে অনশন ভেঙে আন্দোলন করো। আন্দোলন আর অনশন ভিন্ন জিনিস! আমি এসেছি তোমাদের অনশন ভাঙাতে।’ পরে সকালে শিক্ষার্থীরা তার হাতে পানি পাণ করে অনশন ভাঙেন।
শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করেছিলাম যারা অনশন করতেছে তাদের যথাযথভাবে মেডিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছে। তবে এখানে এসে যা দেখলাম তা দেখে খুবই হতাশ হয়েছি। চিকিৎসা না দিয়ে ডাক্তাররা খুবই অমানবিক কাজ করেছেন।’
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে জাফর ইকবাল বলেন, ‘এই কয়দিনে তোমরা দেশের সব মহলকে দেখিয়ে দিয়েছ। তোমাদের কথা সবার কাছে পৌঁছে গেছে। আমি নিজেও এখান থেকে ফিরে তোমাদের কথা পৌঁছে দেব। আমি চাই না তোমরা নিজেদের জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলে দাও। তাই তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি তোমাদের দেখতে আর অনশন ভাঙাতে।’
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হাতে টাকার অনুদান তুলে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তোমাদের হাতে ১০ হাজার টাকা তুলে দিলাম। এখন দেখি আমাকে কে গ্রেপ্তার করে? আমি দেখতে চাই কারা আমাকে অ্যারেস্ট করতে আসেন।’
এ সময় ড. ইয়াছমিন হক বলেন, ‘আমার মনে হয় যে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে তা নামসর্বস্ব। এখন প্রতিটি ঘণ্টা তোমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই তোমরা অনশন ভেঙে আন্দোলন চালিয়ে যাও। তবে এজন্য তোমাদের বেঁচে থাকতে হবে। আমি এর আগে অনেক আন্দোলন দেখেছি এবং করেছি। তবে এমন নিষ্ঠুর আচরণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে করতে দেখিনি!’
শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘এতদিন আমাদের কথা শোনার মতো কেউ ছিল না। আমরা স্যার আপনাকে বিশ্বাস করি। আপনার আশ্বাসে আমরা অনশন ভাঙছি। তবে আমাদের কথা দিয়ে আপনারা তা ভাঙবেন না সে বিশ্বাস আমাদের আছে।’
মঙ্গলবার আন্দোলনকারীরা তাদের সহপাঠীদের অনশন ভাঙার ঘোষণা দেন। তবে তারা চেষ্টা করলেও অনশনকারীরা নিজেদের দাবিতে অনড় থাকেন এবং অনশন চালিয়ে যান। এর আগে শিক্ষামন্ত্রীসহ বিভিন্ন মহল থেকে শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙানোর চেষ্টা করে তা সফলতার পথ পায়নি। অবশেষে শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে ড. জাফর ইকবালের ভরসা পেয়ে অনশন ভাঙতে সম্মত হন শিক্ষার্থীরা।
উল্লেখ্য, অনশন ভাঙার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক এবং শিক্ষক সমিতির কেউ উপস্থিত ছিলেন না। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী হাসান সাজিদ দ্য ডেইলি স্টার বাংলাকে বলেন, শিক্ষক বা শিক্ষক সমিতির কেউ উপস্থিত ছিলেন না। তারা ভ্রুক্ষেপ করছেন না। শিক্ষক সমিতির দু’একজন শিক্ষক এসেছেন, সেটা শুধুমাত্র মর্নিং ওয়াকের জন্য। তারা এসেছিলেন, দেখে গেছেন।
আমরণ অনশন ভাঙলেও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীদের এক মুখপাত্র। বুধবার সকালে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
ঐ শিক্ষার্থী বলেন, অনশন ভাঙার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে। শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হক গতরাতে এসেছেন এবং আমাদের বিশ্বাস-আশ্বাস দুটোই দিয়েছেন যে, তাদের কাছে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এসেছিলেন এবং বলেছেন যে আমাদের যে দাবি-দাওয়াগুলো আছে সেটা পূরণ করে দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, তারা আমাদের অসম্ভব শ্রদ্ধেয় এবং উনাদের কথা আমরা বিশ্বাস করি, তাদের কথা বিশ্বাস করেই আমরা অনশন ভেঙেছি।
মুখপাত্র বলেন, আমাদের আন্দোলন আগের ঘোষণা অনুযায়ী ভিসির পদত্যাগের আগ পর্যন্ত চলার কথা, আপাতত আমরা অনশন কার্যক্রম বন্ধ করছি। আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি চলবে, বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যাব।
এদিকে, আন্দোলনে অর্থ জোগান দেওয়ার অভিযোগে আটক সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতপরিচয়ের আরও ১৫০ জনের বিরুদ্ধে সিলেট মেট্রোপলিটনের জালালাবাদ থানায় মামলা করেছে শাবি প্রশাসন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হুদা খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সিলেট সিটি পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বিএম আশরাফউল্লাহ তাহের ঢাকা ট্রিবিউন বাংলাকে জানান, মঙ্গলবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই মামলা হয়েছে। তবে প্রশাসনের কে বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে আন্দোলন চলার মধ্যে ঢাকায় গ্রেপ্তার বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীকে আটকের পর সিলেটের জালালাবাদ থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। গ্রেপ্তার পাঁচজন হলেন- কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান স্বপন এবং স্থাপত্য বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী রেজা নূর মুঈন দীপ ও নাজমুস সাকিব দ্বীপ এবং এ কে এম মারুফ হোসেন ও ফয়সাল আহমেদ।
পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফউল্লাহ বলেন, মামলার এজাহারে অসৎ উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অর্থ জোগান এবং আন্দোলনকারীদের উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।
প্রসঙ্গত, গত ১৩ জানুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েকশ ছাত্রী।
এ ঘটনায় ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যার দিকে হলের ছাত্রীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এছাড়া ১৬ জানুয়ারি ছাত্রীরা উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখে। খবর পেয়ে পুলিশ লাঠিচার্জ ও রাবার বুলেট ছুঁড়ে ভিসিকে মুক্ত করে। এতে অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হন।
এরপর থেকে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। গত বুধবার বেলা ৩টা থেকে অনশন কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। শুরুতে ২৪ জন শিক্ষার্থী অনশনে অংশ নেন। পরে ১ জন পারিবারিক কারণে অনশন থেকে বাড়িতে চলে যায়। এরপর রোববার গণঅনশনের অংশ হিসেবে নতুন করে যোগ দেন আরও ৫ শিক্ষার্থী। ফলে শেষ পর্যন্ত অনশনে অংশ নেওয়া মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮ জনে। ২৬ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের সে অনশনের অবসান হয়। এতে তাদের মুখে আবারও স্বস্তির হাসি ফোটে। সূত্র : বাংলানিউজ, দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ঢাকা ট্রিবিউন বাংলা