
কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর প্রয়াত

প্রিয়াংকা আচার্য্য : ভারতের সর্বকালের সেরা সংগীত শিল্পীদের অন্যতম লতা মঙ্গেশকর ৯২ বছরে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে শেষ নিংশ^াস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গীত পিপাসুদের মাঝে শোকের মাতম চলছে। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনীতিক, শিল্পীসহ সাধারণ মানুষ তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার ও ইন্সট্রাগ্রামে পোস্ট দিচ্ছেন।
কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রায় চার সপ্তাহ ভারতের মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় রোববার সকালে তার মৃত্যু হয়।
দেশভাগেরও আগে ১৯৪২ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শুরু করা লতা অল্প সময়েই হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য একটি নাম। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে হাজারেরও বেশি সিনেমায় গান করেছেন লতা। ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষাতে ৩০ হাজারের বেশি গান তিনি গেয়েছেন।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে পর গত ১১ জানুয়ারি ঐ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল লতা মঙ্গেশকরকে। করোনা ভাইরাসমুক্ত হওয়ার পর অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছিল। কিন্তু পরে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। অবস্থার অবনতি হলে শনিবার তাকে আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে নেওয়া হয়।
শনিবার সন্ধ্যায় তাকে দেখতে হাসপাকতালে যান বোন আশা ভোঁসলে। বলিউডের আরেও অনেকেইছুটে যান এই মহাতারকার খোঁজ নিতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই জানান শুভকামনা। কিন্তু সবাইকে শোকে ভাসিয়ে রোববার সকালে চিরবিদায় নিলেন এ শিল্পী।
ভারতরতœ লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিকে শোক জানিয়ে টুইট করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তার জন্য ভারতীয় শিল্পীরা এগিয়ে আসেন। সেসময় লতা মঙ্গেশকর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন।
এরপর মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন স্থানে গান পরিবেশন করেছিলেন কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পী। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষ অনুষ্ঠানে সবার সঙ্গে সাক্ষাৎও করেন। ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সে ঘটনার উল্লেখ করে তিনি টুইটারে একটি পোস্ট দেন।
টুইটারে তিনি লিখেছিলেন, নমস্কার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতেই আমি সুনীল দত্তের গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশ গিয়ে অনেক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলাম। সে সময়ে সেনাবাহিনীর উড়োজাহাজে করে সব জায়গায় গিয়েছিলাম।
সে সময় লতা মঙ্গেশকর ছাড়াও আশা ভোসলে, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মোহাম্মদ রফি, মান্না দে, সলিল চৌধুরী প্রমুখ বাংলাদেশের জন্য ভারতের বিভিন্ন স্থানে সংগীত পরিবেশন করেন।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে লতা মঙ্গেশকর একমাত্র গানটি করেন। ঐ বছর মমতাজ আলীর পরিচালনা ও সলিল চৌধুরীর সঙ্গীত নির্দেশনায় রক্তাক্ত বাংলা নামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে ‘ও দাদাভাই’ গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। তার সঙ্গে সহযোগিতায় ছিলেন আলাউদ্দীন আলী ও তার অর্কেস্ট্রা দল। লতা মঙ্গেশকর ছাড়াও এ ছবিতে প্লেব্যাক করেন মান্না দে ও সবিতা চৌধুরী।
এদিকে লতার মৃত্যুতে ভারতীয় সরকার সূত্রে ২ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন হবে লতা মঙ্গেশকরের শেষকৃত্য।
উল্লেখ্য, লতা মঙ্গেশকরের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর, ভারতের ইন্দোরে। বাবা দীনানাথ মুঙ্গেশকর ছিলেন ধ্রপদ শিল্পী, মারাঠি থিয়েটারের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি। তার কাছেই লতার গান শেখার শুরু। কৈশোরেই বাবাকে হারালেও গান শেখা ছাড়েননি। ওস্তাদ আমান আলী খানের কাছে ক্লাসিকাল শিখতেন লতা। ১৯৩৮ সালে বাবার সঙ্গে প্রথম মঞ্চে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ৪১ সালে স্টুডিওতে প্রথম গান করে। এরপর ৪২-এ ‘কিটি হাসাল’ নামে এক মারাঠি সিনেমায় তার প্লেব্যাক ক্যারিয়ার শুরু।
তখন কেএল সায়গল, শামশাদ বেগম ও নুরজাহানদের যুগ। শুরুর দিকে লতা মঙ্গেশকরকে শুনতে হয়েছিল, তার কণ্ঠস্বর একটু বেশিই পাতলা।
তাকে প্রথম সুযোগ দেন মাস্টার গুলাম হায়দার। তার পরেই আসে ‘মহল’-এর সেই বিখ্যাত গান ‘আয়েগা আনেওয়ালা’। সেই সিনেমা ১৬ বছরের মধুবালা ও ২০ বছরের লতা, দুজনের জন্যই ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। নায়িকা ও গায়িকার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ওই সিনেমার পর। সেই পথ ধরেই লতার কণ্ঠ হয়ে ওঠে বলিউডের ‘গোল্ডেন ভয়েস’।
১৯৪৯ সালে লতার কণ্ঠে ‘জিয়া বেকারার হ্যায়’ উতলা করে তোলে শ্রোতাদের মন। ১৯৫৫ সালে ‘মন দোলে মেরা তন দোলে’ দুলিয়ে দেয় ভারতবর্ষ। ১৯৫৭ সালে ‘আজারে পরদেশী’ গানে তিনি জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যান, হয়ে ওঠেন সংগীত পরিচালক আর চলচ্চিত্র প্রযোজকদের নয়নের মনি।
বাংলাদেশের একাধিক প্রজন্মের কাছেও লতার কণ্ঠ স্বপ্নের মত। বাংলা সিনেমাতেও প্রায় ২০০ গান রয়েছে লতার। তার কণ্ঠের ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’, ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায়’, ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘যা রে উড়ে যারে পাখি’, ‘বলছি তোমার কানে’, ‘চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়’ এর মত বহু গান এ দেশের মানুষ মনে রাখবে আরও বহু দিন।
প্রয়োজন অনুযায়ী গায়কী আর কণ্ঠ বদলে নেওয়ার অসাধারণ দক্ষতা ছিল লতার। একই সিনেমায় তিনি তিন নায়িকার গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন।
প্রখাত সংগীত পরিচালক নওশাদ আলী বলেছিলেন লতার মত সংগীত প্রতিভা আমি আর পাইনি। বিভিন্ন মাধ্যমেই এক একজন আসেন, যার মাথায় ঈশ্বর হাত রাখেন, লতা তেমনই একজন।
তবে শুধু প্রতিভাই সব ছিল না, লতার ছিল জীবনই ছিল সাধনা আর সংগ্রাম। যতীন মিশ্রর ‘লতা সুর গাঁথা’তে লতা বলেছিলেন, প্রায়ই রেকর্ডিং করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম আমি। আর ভীষণ খিদে পেত। তখন রেকর্ডিং স্টুডিওতে ক্যান্টিন থাকত, তবে নানান রকম খাবার পাওয়া যেত কি-না, সে বিষয়ে আমার মনে নেই। তবে চা-বিস্কুট খুঁজে পাওয়া যেত তা বেশ মনে আছে।
এক কাপ চা আর দু চারটে বিস্কুট খেয়েই সারাদিন কেটে যেত। এমনও দিন গেছে যে দিনে শুধু জল খেয়ে সারাদিন রেকর্ডিং করছি, কাজের ফাঁকে মনেই আসেনি যে ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাবার খেয়ে আসতে পারি। সারাক্ষণ মাথায় এটাই ঘুরত, যেভাবে হোক নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাকে।
বলিউডে লতা মঙ্গেশকরকে নিজের ছোট বোনের মতো দেখতেন নায়ক দিলীপ কুমার। আবার লতাও দিলীপ কুমারকে সব থেকে কাছের মানুষ মনে করতেন ইন্ডাস্ট্রিতে।
লতাকে ভেবেই ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ এর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন রাজ কাপুর। তিনি চেয়েছিলেন, লতা সেখানে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করুন। কিন্তু লতা সায় দেননি। অনেক পরে জিনাত আমান সেই ভূমিকায় অভিনয় করেন।
২০০১ সালে লতা মঙ্গেশকরকে ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ভারতরতœ দেয়া হয়। ১৯৮৯ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন।
আকাশছোঁয়া খ্যাতির পথে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। ১৯৮৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পাওয়া এই শিল্পীকে ১৯৬৯ সালেই পদ্মভূষণে ভূষিত করেছিল ভারত সরকার। ১৯৯৯ সালে তাকে পদ্মবিভূষণ দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইট বার্তায় তিনি লেখেন, ‘তার চলে যাওয়া এমন এক শূন্যতা তৈরি করল, যা কখনই পূরণ হওয়ার নয়। ভারতীয় সংস্কৃতির একজন কিংবদন্তি হিসেবেই লতা মঙ্গেশকরকে মনে রাখবে আগামী প্রজন্ম, যার সুরেলা কণ্ঠ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে।
