ব্রেক অব স্টাডি যেন উচ্চশিক্ষায় বাঁধা না হয় সে সুযোগ তৈরি করতে হবে : শিক্ষামন্ত্রী আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে দাঁড়ানোই সরকারের লক্ষ্য
শরীফ শাওন : শিক্ষার্থীরা নিজেরা উদ্যোক্তা হবে, অন্যকে কাজ দেবে, সেভাবেই তাদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে তাদের গড়ে উঠতে হবে। আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ^ দরবারে দাঁড়ানোই আমাদের লক্ষ্য। আশা করি, তারা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
রোববার দুপুরে রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনষ্টিটিউটে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
আমাদের শিক্ষার্থীরা মেধাবী জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসময় তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। কেবল গতানুগতিক ডিগ্রি নিলে হবে না। সাধারণত মানুষ পড়াশোনা করে কর্মসংস্থান ও আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য। তাই প্রযুক্তিগত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। সময়োপযোগী শিক্ষা নিতে হবে। বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা কারিগরি স্কুল করছি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের দোরগোড়ায়। গবেষণা বাড়াতে হবে, গবেষণার ফলে খাদ্যে আজ আমরা সয়ং সম্পুর্ন। এতে খাদ্যসহ পুষ্টিচাহিদা নিশ্চিত করেছি। বিজ্ঞান ও মেডিক্যাল সাইন্সে গবেষণা বাড়াতে হবে। ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে এটা খুব প্রয়োজন। প্রযুক্তিগত শিক্ষায় আমরা বিপুল প্রতিষ্ঠান ও ল্যাব স্থাপন করছি।
শেখ হাসিনা বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছি। ৯৬ তে দেখেছি এসকল শিক্ষায় কারো তেমন আগ্রহ ছিলো না। ১২টি প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিশ^বিদ্যালয়ের প্রকল্প গ্রহন করে ৬টির নির্মাণ কাজ শুরু করি। এখন শিক্ষাকে বহুমূখিকরণ করে দিচ্ছি, জেলায় জেলায় বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গে কৃষি বিশ^বিদ্যালয় করেছি, মেডিক্যাল ও ডিজিটাল বিশ^বিদ্যালয় ও ফ্যাশন, টেক্সটাইলসহ বহুমুখি বিশ^বিদ্যালয় করছি যেন শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের সুযোগ হয়। তাদের যুগোপযুগি শিক্ষার সঙ্গে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে এসকল পদক্ষেপ নিয়েছি।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বিনা মূল্যে বই ও পোষাক দিয়েছে, আমরা সেই ধারা অব্যাহত রেখেছি। চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে প্রায় ৪ কোটি ১৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৫৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৫ কোটি ৭০ লাখ ২২ হাজার ১২৩ কপি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ চলমান রয়েছে। ২ কিলোমিটারের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছি ৯৬ সাল থেকেই। ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৫৪ হাজার ৬১১ জন শিক্ষার্থীকে আর্থিক সহায়তাসহ বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ বছর পর সরকার গঠন করে দেখেছি স্বাক্ষরতা ছিলো ৪৫ শতাংশের মতো। এটি দুর্ভাগ্য। কুদরতি ক্ষুদার শিক্ষানীতির আলোকে তা যুগোপযোগী করতে একটি কমিশন গঠন করি। সকল কাজ সম্পন্ন করার আগে ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তন হয়। ৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন আমরা একটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম, নিরক্ষর মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। প্রত্যেক জেলায় বয়স্ক শিক্ষা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষা ও মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষার উপর জোর দেই। কারিগরি ও বিজ্ঞান এবং কম্পিউটার শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করি। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা ৬৫ দশমিক ৫ ভাগে উন্নীত করতে সক্ষম হই। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে না পেরে ২০০৮ এর জয়ী হয়ে দেখি তা আবার পূর্বের জায়গায় ফিরে এসেছে। আজকে তা আবার ৭৫ ভাগ শিক্ষার হারে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি।
এ মাসের শেষের দিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আশা জানিয়ে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে টিকা কার্যক্রম জোরদারভাবে চলছে। সকলকে অনুরোধ শিগগিরই যেন টিকা নিয়ে নেন। আশা করি এ মাসের শেষের দিকে অবস্থার পরিবর্তন হবে সেসময় স্কুল কলেজ খুলে দিতে পারবো। তিনি বলেন, করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুল কলেজে পাঠদানের পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সীমিত আকারে হলেও পরীক্ষার আয়োজন ও ৪৪ দিনের মধ্যেই ফল প্রকাশ করায় শিক্ষা বোর্ড ও সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, পড়াশোনায় বয়স বা অন্য কোন বাধা থাকার কথা না। কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা বয়সের বাধা তুলে দিয়েছি। আমরা যারা বিশে^র বিভিন্ন জায়গায় পড়ার সুযোগ পেয়েছি বিভিন্ন বয়সে পড়েছি। সেখানে বয়স বা ব্রেক অব স্টাডি কোনটাই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আমাদেরও একসময় সেই জায়গায় যেতে হবে। তবে এ পরিস্থিতি সৃষ্টিতে আরও কিছু সময় লাগবে কিনা তা বিবেচনার বিষয়। তবে শিক্ষাকে সকলের জন্য, যে কোন জায়গা থেকে, যেন সকলে সুযোগ পায় সেই সুযোগ আমাদের করে দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের সুযোগ বাড়ালে তো সমস্যা নেই। বিশ^বিদ্যালয় ভর্তিতে যে মেধা চাওয়া হয়, একাধিকবার সুযোগ দিলেও তাতে সমস্যা থাকার কথা না।
মন্ত্রী বলেন, মেডিক্যাল ও অন্যান্য বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসেই পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বলেছি। গুচ্ছ ভর্তিতে যারা এসেছেন এবং বড় যে চারটি বিশ^বিদ্যালয় আসেনি তাদেরও বলেছি। আমার মতে এসকল শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে ভর্তি পরীক্ষা না হওয়া সমুচিত হবে না।
কম বিষয়ে ও কম সময়ের পরীক্ষার কারণে ফলাফল ভালো হয়েছে জানিয়ে বলেন, পাশের হার অধিক হলেও সকলকে গতানুগতিকভাবে অনার্স মাষ্টার্স করার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর কোথাও এরকম দেখা যায় না। এছাড়াও আমাদের পর্যাপ্ত পরিমান স্কুল কলেজ সহ পর্যাপ্ত আসন সংখ্যা রয়েছে। ফলে ভর্তি নিয়ে সংকট থাকার কথা না। এছাড়াও নতুন বিশ^বিদ্যালয় হচ্ছে। মানের বিষয়ে বলেন, নতুন হলে মান গড়তে কিছুটা সময় লাগে। তবে আমরা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, ফলে দ্রুতই তা কটিয়ে উঠতে পারবো।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল স্বাগত বক্তব্যে জানান, শুধু অনার্স মাষ্টার্স দিয়ে কর্মসংস্থান বা সামলম্বি হওয়া এখন আর সম্ভব না। প্রতি জেলায় বিশ^বিদ্যালয়, বিশেষায়িত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশে বিদেশে দক্ষ মানব সম্পদ ও জ্ঞান নির্ভর অর্থনীতি উপযোগি কর্মযজ্ঞ প্রজন্ম সৃষ্টি করতে চাই। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুরোধ করেছে, গতানুগতি অনার্স মাষ্টার্স কোর্সের পাশাপাশি যুগোপযোগী দক্ষতা ও শিল্প নির্ভর কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত যেসকল প্রযুক্তি আছে, ভাষা ও সফট স্কিল, কমিউনিকেশন, রিসার্চ দক্ষতার উপর মডিউলার ও সর্ট বিশেষায়িত কোর্স চালু করতে। এর পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার মৌলিক কোর্স মানোন্নয়নে বাংলাদেশ এক্রিডিটেশন কাউন্সিল, বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং কারিগরি বিভাগ একসঙ্গে কাজ করে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ইতোমধ্যেই আমরা বাংলাদেশ কোয়ালিফিকেশন ফ্রেম ওয়ার্ক (বিকিউএফ) প্রবর্তন করেছি। পর্যায়ক্রমে সকল উচ্চশিক্ষা কোর্স এর আওতায় আসবে। এর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিভিন্ন স্তরে সনাদায়নের ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করা হচ্ছে। শুধু দীর্ঘমেয়াদি অনার্স মাষ্টার্স দিয়ে আমাদের তরুন প্রজন্মকে দ্রুত আগত অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যাবে না।
একজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষাকালে এক থেকে তিন বছর মেয়াদি সর্ট কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স, সার্টিফিকেট কোর্স ও হায়ার কোর্স করতে পারেন এবং যাতে কাজে যোগদান করতে পারেন। পরবর্তীতে সম্ভব হলে কর্মজীবনের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষায় ফ্রেক্সিবল এবং মডিউলার্ন লার্নিংয়ের মাধ্যমে সেই অনার্স ও মাষ্টার্স যেন শেষ করতে পারেন সে লক্ষ্যেই বিকিউএফ প্রবর্তন করা হয়েছে। যেখানে লেটারাল এন্ট্রির ব্যবস্থাসহ মডিউলার্ন এডুকেশনকে সবচেয়ে উৎসাহিত করা হবে।
প্রতিযোগী কোর্স প্রণয়নে বিশ^বিদ্যালয়ে পাঠদান ও সিলেবাসে অনেক গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন, যার কাজ চলছে। উপলব্ধি করতে হবে বর্তমান বিশ^ ও আজকের বাংলাদেশ কর্মসংস্থানের জন্য শুধু উচ্চশিক্ষা নির্ভরতা আর নেই। কর্মীর উচ্চশিক্ষা না থাকলেও দক্ষতা আছে কিনা তা দেখতে চায় কর্মদাতারা। তাই নানান বাস্তবতায় উচ্চশিক্ষায় গেলেও এসকল প্রশিক্ষণ নিতেই হবে। দেশে যে বিনিয়োগ আসছে এবং অনলাইনে যে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তার সুফল নিতেও মাইক্রো সার্টিফিকেট এর মত নানান ছোট ছোট কোর্সের মাধ্যমে নিজের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য দক্ষতা নির্ভর কোর্স করতে যেন মনযোগী হই।