নিষেধাজ্ঞায় আক্রান্ত রুশ অর্থনীতিকে খুব বেশি সাহায্য করতে পারবে না চীন
রাশিদ রিয়াজ : কৌশলগত সম্পর্কের কারণে রাশিয়াকে চীন অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে চাইলেও তা খুব একটা সম্ভব হবে না বলে সিএনএন’র বিশ্লেষণে বলা হয়েছে। গত কয়েক বছরে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক অনেক দূর গড়িয়েছে। ২০১৯ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে সেরা ও ভালো বন্ধু বলে অভিহিত করেন। গত মাসে পুতিনের বেইজিং সফরকালে দুই রাষ্ট্র তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে অসীম বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু গত সপ্তাহে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে এই দুই দেশের মধ্যেকার বন্ধুত্বের সীমা কতদূর এটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করার পর পশ্চিমা দেশগুলির নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছে রাশিয়া। এখন, তার প্রতিবেশীকে সাহায্য করার জন্য চীনের ক্ষমতা কঠোরভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেইজিংয়ের বিকল্প সীমিত।
ফাউন্ডেশন ফর দ্য ডিফেন্স অফ ডেমোক্রেসিসের সিনিয়র চায়না ফেলো ক্রেগ সিঙ্গেলটন মনে করেন, চীনের নেতারা ইউক্রেনের উপর রুশ হামলার পর একটি খুব কঠিন শক্ত পথ হাঁটছেন। বিশ্বজুড়ে নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতির নিন্দা করার পরে বেইজিং রাশিয়াকে সাহায্য করতে ছুটে আসেনি। বুধবার, চীনের ব্যাংকিং এবং বীমা নিয়ন্ত্রক কমিশনের চেয়ারম্যান গুও শুকিং বলেছেন যে দেশটি নিষেধাজ্ঞাগুলিতে অংশ নেবে না, তবে তিনি পাল্টা ব্যবস্থার কথাও বলেননি। এই সপ্তাহের শুরুতে, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার ইউক্রেনের প্রতিপক্ষের সাথে কথা বলার পর বলেন, চীন সংঘাত দেখে গভীরভাবে শোকাহত এবং ইউক্রেন ইস্যুতে তার মৌলিক অবস্থান উন্মুক্ত, স্বচ্ছ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এছাড়া বেইজিংয়ের সমর্থিত একটি উন্নয়ন ব্যাংক এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তারা রাশিয়ায় তাদের সমস্ত কার্যক্রম স্থগিত করছে। ক্রেগ সিঙ্গেলটন মনে করেন ইউক্রেন যুদ্ধের পর চীনের জটিল অবস্থান আভাস দিচ্ছে বেইজিং রাশিয়াকে উস্কে দেওয়ার জন্য ওয়াশিংটন এবং তার মিত্রদের দোষারোপ করতে থাকবে। কারণ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক বিরোধপূর্ণ অবস্থান থাকায় সে সম্পর্কের সম্পূর্ণ ভাঙ্গন এড়াতে বেইজিংয়ের আকাঙ্খার কারণে এই ধরনের পদক্ষেপগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বিরোধিতা করার চেয়ে তা বরং অনেক কম হবে।
রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ কিন্তু তা অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যবসায়িক লেনদেনে সীমাবদ্ধ। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের আগে, পুতিন চীনের সাথে তার দেশের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে গভীর করেছিলেন। তার সাম্প্রতিক চীন সফরের সময়, দুই দেশ রাশিয়ান শক্তি জায়ান্ট গ্যাজপ্রম এবং রসনেফটের সঙ্গে নতুন চুক্তি সহ ১৫টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চীনও রাশিয়ার গম ও বার্লির ওপর থেকে সব ধরনের আমদানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে সম্মত হয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে গত বছর, চীনের তেল আমদানির ১৬ শতাংশ রাশিয়া থেকে এসেছিল। সৌদি আরবের পরে রাশিয়া এখন চীনে দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী দেশ। চীনের প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৫ শতাংশ গত বছর রাশিয়া থেকে এসেছে।
পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্স অনুসারে রাশিয়া, ইতিমধ্যে, চীন থেকে তার প্রায় ৭০ শতাংশ সেমিকন্ডাক্টর কিনেছে। রাশিয়া চীন থেকে কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন এবং গাড়ির যন্ত্রাংশও আমদানি করে। সাওমি রাশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় স্মার্টফোন ব্র্যান্ডগুলির মধ্যে একটি।চীন তার ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাঙ্ক পেমেন্ট সিস্টেমে রুশ ব্যাঙ্কগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে, একটি ক্লিয়ারিং এবং সেটেলমেন্ট সিস্টেম বা সুইফ্টএর সম্ভাব্য বিকল্প হিসাবে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে পশ্চিমা দেশগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য চীন ও রাশিয়ার কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনের আক্রমণ সে বন্ধুত্বকে পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে। ইউরেশিয়া গ্রুপের চীন বিশ্লেষক নিল থমাস বলেছেন, এখনও এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি যে চীন রাশিয়াকে সাহায্য করার বিষয়টি পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন হিসেবে মনে করছে। আবার এও সত্যি যে রাশিয়ার ওপর আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞাগুলির একটি প্রকাশ্য অমান্য করার চীন প্রচেষ্টা বিরাট অর্থনৈতিক শাস্তি হিসেবে দেখা যেতে পারে।
রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যে চীনের প্রয়োজন হলেও বেইজিংয়ের অন্যান্য অগ্রাধিকার রয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং চীনা কাস্টমস ডেটা থেকে ২০২০ সালের পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে সিএনএন বিজনেসের গণনা অনুসারে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন হচ্ছে রাশিয়ার পহেলা ট্রেডিং পার্টনার। কিন্তু চীনের জন্য, রাশিয়া অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ কারণ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চীনের মোট বাণিজ্যের পরিমাণের মাত্র ২ শতাংশ। বরং চীনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যের অনেক বড় শেয়ার রয়েছে। চীনা ব্যাংক এবং কোম্পানিগুলি রুশ প্রতিপক্ষের সাথে চুক্তি করলে সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা রয়েছে। বেশিরভাগ চীনা ব্যাঙ্কগুলি মার্কিন ডলারে লেনেদেনের সুবিধা হারাতে পারে না এবং অনেক চীনা শিল্প মার্কিন প্রযুক্তিতে যে সুবিধা পাচ্ছে তাও হারাতে চায় না। সাম্প্রতিক মাসগুলিতে চীনের অর্থনীতি এবং শিল্প উৎপাদন ব্যাপক চাপের মধ্যে রয়েছে তা স্বীকার করে, চীনা নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত পশ্চিমা নিয়ন্ত্রকদের বিরোধিতা না করে রাশিয়াকে সমর্থন করার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করবে বলে সিঙ্গেলটন মনে করছেন।
এমনকি নিষেধাজ্ঞার বাইরে জালানি খাতেও রাশিয়াকে চীন সহায়তা বাড়াতে চাইলে বেইজিংকে কঠিন বাধার মুখে পড়তে হতে পারে। ক্যাপিটাল ইকোনোমিক্স’এর প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্ক উইলিয়ামস বলেন রাশিয়ার ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞাগুলো উল্লেখযোগ্য ও বাস্তবিকই চীনের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। চীনের সিআইপিএস আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা রাশিয়া সুইফ্টের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলেও তা খুবই সীমিত আকারে সম্ভব হবে। এর কারণ হচ্ছে সিআইপিএসে মাত্র ৭৫টি ব্যাংক লেনদেন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত এবং সুইফ্ট লেনেদেনে রয়েছে ১১ হাজার প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য। সুইফটে ৩শ রুশ ব্যাংক লেনদেনে জড়িত থাকলেও সিআইপিএস লেনদেনে মাত্র ডজন দুয়েক রুশ ব্যাংক জড়িত। তাছাড়া চীনা মুদ্রা ইউয়ান বৈশি^ক লেনদেনে ৩ শতাংশ অবদান রাখলেও মার্কিন ডলার ইউয়ানের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি লেনদেন করে।
এমনকি চীন ও রাশিয়ার বাণিজ্যিক লেনদেন ইউয়ান নয় ডলার ও ইউরোর মাধ্যমেই প্রাধান্য পায়। গত সপ্তাহে, বিডেন প্রশাসন রাশিয়ায় মার্কিন প্রযুক্তিতে নির্মিত প্রযুক্তিগত রপ্তানি বা বিদেশী পণ্যগুলিকে সীমাবদ্ধ করার জন্য একাধিক ব্যবস্থার ঘোষণা করেছে। রাশিয়া চীন থেকে বেশিরভাগ কম্পিউটার চিপ আমদানি করে, যেগুলো গাড়ি এবং গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু রাশিয়া এবং চীন উভয়ই উন্নত অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় চিপগুলির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে। রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, গত সপ্তাহে মার্কিন প্রশাসনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা একটি মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, চীন একা রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর জন্য সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা সরবরাহ করতে পারে না।