যখন তখন হনর্, অতিষ্ঠ নগর জীবন
শিমুল মাহমুদ : এক যুগের বেশি সময় ঢাকার রাস্তায় রিকশা চালান হাসু মিয়া। বয়স বাড়ার সঙ্গে শরীরে রোগবালাই বাড়ছে তার। জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেছেন কানের সমস্যা নিয়ে।
জানতে চাইলে হাসু বলেন, কানে কম শুনি। ডাক্তার কইলো, সারা দিন রাস্তায় থাহি, শব্দে কান দুইডা গেসে। মেইন রোডে রিকশা চালাইতে মানা করসে।
ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের ডিসি সাহেদ আল মাসুদ বলেন, ট্রাফিক সিগন্যাল ও জ্যামে আটকে থাকার সময় সামনে এগুনো যাবে না জেনেও হর্ন বাজাতে থাকে। বিশেষ করে, সিগন্যাল ছাড়ার সময় এক সাথে হর্ন দিতে থাকে ৫০-৬০ গাড়ি।
তিনি বলেন, ৯/১০ ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। বাসায় ফিরলেও এর প্রভাব থাকে। কানে শুধু শব্দ বাজে। মেজাজ ঠিক থাকে না। আস্তে কথা কানে যেন আসে না। আমি মনে করি সমাধান একটায় প্রথমে মানুষের নিজের সচেতনতা।
বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দের মান পরিমাপ করে দেখেছে। তাদের জরিপে দেখা গেছে, উত্তরার শাহজালাল অ্যাভিনিউতে শব্দমাত্রা সর্বোচ্চ ৯৩ দশমিক ৫ ডেসিবল, মিরপুর- ১ এ সর্বোচ্চ ৯৬, পল্লবীতে সর্বোচ্চ ৯১ দশমিক ৫, ধানমন্ডি বালক বিদ্যালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ১০৭ দশমিক ১, ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে সর্বোচ্চ ৯৫ দশমিক ৫, নিউ মার্কেটের সামনে ১০৫ দশমিক ১, শাহবাগে সর্বোচ্চ ৯৭ দশমিক ৩ এবং সচিবালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ৮৮ ডেসিবল পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ঢাকা শহরে গড় শব্দের মান ১০০ ডেসিবল, যা খুবই আতঙ্কজনক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের স্বাভাবিক শব্দ গ্রহণের মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল। অথচ ঢাকা শহরের শব্দের মাত্রা ১৩০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে গেছে। যা স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে আড়াই থেকে তিনগুণ বেশি। ব্যক্তিগত গাড়ি আর মোটর সাইকেলের কারণে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ হয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৯০ ডেসিবল শব্দে আড়াই ঘন্টা আর ৯৫ ডেসিবল শব্দে টানা ৪৭ মিনিট থাকা যায়। এর বেশি সময় থাকলে, হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি হ্রাস, স্নায়ুর সমস্যা ও মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে। বিধিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় রাত নটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল।
হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। অথচ মানুষের আইন মানার অনীহা যেমেন রয়েছে সেই সঙ্গে সচেতনতার অভাব দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশ প্রাণীবিজ্ঞান সমিতির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. গুলশান আরা লতিফা বলেন, শব্দদূষণের ফলে জলজপ্রাণীর ক্ষতি হয়, একেক ধরনের প্রাণীর শ্রাব্যতা সীমা একেক রকম। ফলে মাত্রাতিরিক্ত শব্দের ফলে তারা দিশেহারা হয়ে যায়। সকলকে এক ছাদের নিচে এসে সম্বলিত ভাবে এই শব্দদূষণ রোধে কাজ করতে হবে। এবং এর মাধ্যমে মানুষ ও প্রাণীর নিরাপদ শ্রবণ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, হাইড্রলিক হর্ন বাজানো নিষেধের আগে এর বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। শব্দদূষণ গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত ডাটাবেজ সংরক্ষণ করতে হবে এবং তা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, প্রাণ প্রকৃতির উপর শব্দদূষণের প্রভাব রয়েছে, যেসব এলাকায় শব্দদূষণ বেশি হয় ঐ এলাকা থেকে প্রাণীরা অন্য এলাকায় স্থানান্তরিত হয়। ফলে উদ্ভিদের পরাগায়ন ও প্রজনন ব্যাহত হয়।
সর্বশেষ পাঁচ বছর আগে শব্দদূষণের ওপর জরিপ করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। এরপর আর কোনো জরিপ বা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। তবে নতুন করে আরেকটি জরিপের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, আমরা নতুন করে শব্দদূষণের ওপর জরিপ চালাব। তবে ২০১৭ সালের জরিপে যা উঠে এসেছে তা বেশ উদ্বেগজনক। এটি শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি থেকে শুরু করে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের সবার আন্তরিক সহযোগিতা দরকার।