আমজনতার ‘শেখ সাব’ এবং পাকিস্তানবধ কাব্য
অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাত মার্চের ভাষণ একটি কবিতা। এই কবিতার কবি বাঙালির প্রিয় মুজিব। শেখ সাব। শেখ সাবের বজ্রকণ্ঠে সেদিন কেঁপে উঠেছিলো পাকিস্তানি শোষকদের ক্ষমতার মসনদ। জেগে উঠেছিলো বাঙালি জাতি। যখন মুজিব বললেন, ‘ভাইয়েরা আমার…’ জনতা আপনার করে নিয়েছিলো বাংলার বন্ধু বঙ্গবন্ধুকে। ভাই বলে বঙ্গবন্ধুও একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। মন ও মননে। বঙ্গবন্ধু যখন বলেন, ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি…’ তখন লাখ লাখ জনতা দুঃখের দিনের সমাপ্তির শপথ নিয়েছিলো। বলেছি, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘ঢাকা না পিন্ডি, ঢাকা ঢাকা’। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘২৩ বছর আমরা শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়েছে…’ জনতা শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পণ করলো। একসুরে বললো, এই শোষণের দিন শেষ হবে একদিন। আমরা শোষকের বিরুদ্ধে লড়াই করবো।
মুজিব কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন, ‘… সৈন্যরা তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, …আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না, সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না…’ এই দেশের মানুষ বুঝতে পারলো পাকিস্তানিদের দিন শেষ। গর্জে উঠেছে বাংলাদেশ। মুজিব যেখানে অগ্নিশর্মা, সেখানে বাঙালি আগুনপাখি। আগুন পাখির সামনে পাকিস্তানি বাহিনী পর্যুদস্ত নিশ্চিত হতেই হবে। কোনো পার পাবে না। ন্যায্য অধিকার বাঙালিদের দিতেই হবে। ঠকিয়ে আর কতোদিন রাখবে বাঙালিদের? বাঙালিরা উৎপাদন করবে, তার স্বাদ নেবে তোমরা? হবে না। পারবে না আর অধিকার কেড়ে নিতে।
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন।
বলে গেলেন যে আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করলাম, আপনারা আসুন বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসেন, তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে হবে। যদি কেউ অ্যাসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলি চলবে।
তারপর হঠাৎ ১ তারিখে অ্যাসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো’। এই বাংলার মানুষ বুঝলো কতোটা ছলচাতুরি করছিলো ভুট্টোরা। পাকিস্তান যে আমাদের অধিকার দিতে চায় না, স্বীকৃতি দিতে চায় নাÑবারবার প্রমাণিত হচ্ছিলো। কোনো প্রশ্রিতিই তারা রাখছিলো না। নিরুপায় বাঙালি যুদ্ধ চায় না, চায় শান্তি। কিন্তু শান্তির পথে পা বাড়াতে চায় না পাকিস্তানিরা। তাদের মননে অন্যকে প্রতারিত করার মন্ত্র। কীভাবে বাঙালিকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায়, কীভাবে শাসন ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা যায় সেই ঘৃণ্য চেষ্টাই শাসকদের মধ্যে ছিলো।
বাঙালি ছেড়ে দেওয়া জাতি নয়। আপোস তাদের রক্তে নেই। লড়াই করেই বাঁচতে জানে। লড়াই করে অধিকার নিতে জানে। রক্তে যাদের লড়াই করার মন্ত্র, পাকিস্তানিরা যতোই দুশমনি করে আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখুক, আটকে রাখতে পারবে না। অধিকার আমাদের দিতেই হবে। শেখ সাব বললেন, ‘কী পেলাম আমরা? যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি।
আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের উপরে গুলি করা হয়েছে, কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডাকবো।
আমি বলেছি, কীসের বৈঠক বসবে, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন’।
পাকিস্তানিরা চাইছিলো বাঙালির উপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের নিষ্পাপ হিসেবে দুনিয়াতে দেখাতে! কী তাজ্জব ঘটনাÑঅন্যায় করে কে আর কার উপর চাপায় সেই অপরাধের দায়। বাঙালি মেনে নেবে পাকিস্তানিদের মিথ্যাচার? শেখ সাব মেনে নেবেন? প্রশ্নই উঠে না। রক্তে যার লড়াইয়ের মন্ত্র, জনগণ যার হৃদয়ে স্থান করে নিয়ে আছে, যাকে তিনি নিজেরে চেয়ে ভালোবাসেন তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারেন তিনি? কখনোই না। কারণ মুজিব আর জনতা ছিলো তখন একাকার। এক আত্মা। মানুষ মানুষ ভিন্ন ভিন্ন হলেও আত্মা ছিলো একটাই, স্লোগানও ছিলো একটাÑ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।
নিপীড়িত মানুষের আপনজন, হৃদয়ের মণি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। জনতা বঙ্গবন্ধুকে আপন ভাবতো, বঙ্গবন্ধুও এ দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। তাদের জন্য হৃদয় উজাড় করে দিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন। তাদের জন্য লড়াই দ্বিধা ছিলো না কখনো। যখনই মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্ন আসতো, তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন মানুষের হয়ে। কোনো পদ-পদবির লোভও ছিলো না তাঁর। যে কারণে তিনি বলতে পারেন, ‘ আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে, শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দফতরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না’।
জনগণের শেখ সাব জনগণের মনের কথা পড়তে পারতেন। তাদের কথা বলতেন। তাদের মতামত নিয়ে, তাদের সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতেন। যখন প্রশ্ন এলো পাকিস্তানিরা আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে থাকলে কী করবো? তখন তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
শেখ সাব যা বিশ^াস করতেন, সেটাই বাস্তবায়ন করে ছাড়তেন। সামরিক শক্তিতে বহুগুণে এগিয়ে থাকা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। লড়াই করেছিলেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। মাত্র নয়মাসে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলো। তাঁর সততার কমতি ছিলো না। জনগণ প্রশ্নে শেখ সাব ছিলেন ব্যাকুল প্রায়। তাদের তিনি এতোটাই ভালোবাসতেন, পঁচাত্তরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাঁর হত্যা চেষ্টা হতে পারে জানালেও বিশ^াস করেননি। বরং বলেছিলেন, ওরা আমার সন্তানের মতো। তাদের নিয়েই আমার জীবন। তারা আমাকে হত্যা করবে? এমন প্রশ্ন করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন হত্যা শঙ্কা। এমন নেতা কি আর কখনো পাবে বাঙালি জাতি?
লেখক : প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসক ও ইমিরিটাস অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়