রাজধানীতে মশার রাজত্ব
শিমুল মাহমুদ : রাত ২টা। ঘন ঘন বাঁশিতে ফুৎকার দিচ্ছেন নৈশ প্রহরী শামসুল হক। জিগাতলা সরকারি ৬তলা কোয়ার্টার গলির আরেক মাথা থেকে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঁশিতে ফুৎকার দিচ্ছে অন্য আরেক নৈশপ্রহরী।
ফুৎকারের কারণে জানতে চাইলে, শামসুল হক বলেন, গত দুই মাস সিটি কর্পোরেশন মশার ঔষধ দেয় না। গত কয়দিনে মশার কামড়ে আমার হাত-পা লাল হয়ে ফুলে হয়ে গেছে। সারাক্ষণ চুলকায়। তাই একটু হাঁক ডাক বেশিই দিচ্ছি। গত এক সপ্তাহে বকশী বাজার, বাসাবো, ধানমন্ডি, বাবুবাজার, চানখার পুল, গেন্ডারিয়া, মতিঝিল, গুলশান, তেজগাও, মিরপুর এসব এলাকা ঘুরে জানা যায়। বস্তি থেকে অভিজাত এলাকা। সর্বত্রই মশার রাজত্ব!
মশার উপদ্রব এতটায় বেড়েছে যে, নগরবাসী রীতিমতো আতঙ্কিত। ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনের বেশকিছু এলাকায় মশারি, কয়েল আর স্প্রে করেও প্রতিকার মিলছে না। ফলে মশাবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন ঢাকাবাসী। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার উত্তরা, গুলশান, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, কাঠালবাগান ও পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকায় গড় ঘনত্বে প্রতি ডিপে (মশার ঘনত্ব বের করার পরিমাপক) ৬০টির বেশি মশা পাওয়া গেছে। যেখানে অন্যান্য সময় এসব এলাকায় ১৫ থেকে ২০টি মশা পাওয়া যেতো।
গবেষণায় আর উল্লেখ করা হয়, এই মশাগুলোর বেশিরভাগই কিউলেক্স মশা। তবে ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশার ঘনত্ব এসব এলাকায় এক শতাংশেরও কম।
চলতি মাসে মশার ঘনত্ব চরমে পৌঁছাবে। জরুরি পদক্ষেপ না নিলে তা চারগুণ বেড়ে যাবে। এমন পূর্বাভাস থাকলেও রাজধানী জুড়ে সিটি কর্পোরেশনের মশা নিধন অভিযান খুব একটা দেখা যায়নি বলে অভিযোগ বেশিরভাগ মানুষের।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, ঢাকা দক্ষিণে মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। সকল এলাকায় মশা ঔষধ দেওয়া হয়েছে। আমাদের লোকজনও নিয়মিত যাচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে মশার লার্ভা ধ্বংসের কাজ হচ্ছে আর বিকালে ফগিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। একই সঙ্গে আমাদের যে জলাশয়গুলো রয়েছে এগুলো পরিস্কারের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, আমরা কিন্তু বসে নাই। মশার হটস্পটগুলো চিন্তিত করে নিয়মিত ব্যবস্থা নিচ্ছি। একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়েছি।
তিনি বলেন, প্রতি বছর এসময়ে মশার ঘনত্ব বাড়ে। তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটা সার্ভে হয়, সার্ভের রির্পোট দেখে ঘনত্ব অনুযায়ি আমরা ব্যবস্থা নেই। এখনো সে সার্ভের রিপোর্ট এখনো পাইনি।
এছাড়া মশা নিয়ন্ত্রের বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যে একটা আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে মন্ত্রীর সভাপ্রতিত্বে। পাঁচ সিটি কর্পোরেশন মেয়ররা সেখানে ছিলেন।
বৈঠকে সুনির্দিষ্ট কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে। এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে মশা থেকে ২০টির মতো রোগ ছড়ায়। এর মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং জাপানিজ এনসেফালাইটিস।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশার খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই ১৪টি প্রজাতির মশা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে মশার ঘনত্ব অনেক বেড়ে যায়। কারণ শীতের পর এসময় তাপমাত্রা হালকা বাড়তে শুরু করলে মশার ডিম পাড়ার হার বেড়ে যায়। পাশাপাশি মশার লার্ভাগুলোর বৃদ্ধিও অনেকটা দ্রুত হয়। জাহাঙ্গীরনগরেও সেটিই হয়েছে।
এই সময়ে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। এই মশা ড্রেন, ডোবা, নর্দমা ও পচা পানিতে জন্মায়। তাই নিয়মিত ড্রেন, নর্দমা, ডোবা ও ঝোপঝাড় পরিষ্কার করা উচিত, যোগ করেন কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার।