অনলাইন ব্যবসায়ে নারী উদ্যোক্তাদের নীরব বিপ্লব
শিমুল মাহমুদ : সমাজ ও পরিবারের নেতিবাচক মনোভাব, ব্যাংক ঋণ, ট্রেড লাইসেন্স পেতে হয়রানি, সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবসহ নানান বাধার মুখে পড়ছেন নতুন নারী উদ্যেক্তারা। তবে স্বস্তির বিষয় এমন প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রতিবছর বাড়ছে গ্রামীণ পর্যায়ে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা।
সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, এক দশকে বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তা বেড়েছে ১২৬ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ছিলো দু’লাখেরও বেশি। ২০০৯-১০ অর্থ বছরে প্রায় ৯০ হাজার, আর ২০০২-০৩ অর্থ বছরে ছিলো মাত্র ২১ হাজার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের বড় সংখ্যায় অনলাইনে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা করেছে। বিশেষভাবে শিক্ষিত নারীরা ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ভাইভারে পণ্যের প্রচার করেছেন।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য মতে, এখন দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা। গত এক বছরে এ খাতে লেনদেন হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, এখনো পুঁজিই নারী উদ্যোক্তাদের মূল চ্যালেঞ্জ। ব্যবসার শুরুতে পরিবার থেকে মূলধন দিতে চায় না, ব্যাংক থেকে ঋণ পেতেও ট্রেড লাইসেন্সসহ নানা কাগজপত্র লাগে। জামিনদার লাগে।
তিনি বলেন, ট্রেড লাইসেন্সের শর্তগুলো সব নারী পূরণ করতে পারেন না। বিশেষত শিক্ষার্থীরা। জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬ অনুযায়ী এসএমই খাতে ঋণের ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। তবে তা সব সময় হয় না।
সরকারিভাবে গ্রামীণ পর্যায়ে নবীন নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছে, এসএমই ফাউন্ডেশন, জয়িতা ফাউন্ডেশন, বিসিকসহ আরো বেশ কয়েকটি সংস্থা।
২০১১ সালে জয়িতা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৮০টি সমিতির মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার নারী উদ্যোক্তা তৈরি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ফাউন্ডেশন থেকে বুটিক, বিউটি পার্লার, খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তুলছে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের।
জয়িতা’র নারী উদ্যোক্তা সদস্য খুজিস্তা বেগম জোনাকি বলেন, করোনাকালে বাঙালি নারীর জন্য অনলাইনের বিশাল দুয়ার খুুলে গেছে। বছর দুই আগেও নারীররা ভাবতো কি নিয়ে ব্যবসা শুরু করবে। অনলাইনে না অফলাইনে! পেশা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এমন সুযোগ খুব কম ছিলো। পড়াশোনা করে চাকরি নামের সোনার হরিণেই আটকে ছিলো অনেকের জীবন। এখন সময় বদলেছে। এখন ঘরে ঘরে পাকা রাঁধুনিরা অনলাইনে প্রচুর খাবার আইটেম সেল করেন। জনে জনে ফ্যাশন ডিজাইনার, মেকাপ আর্টিস্ট। যারা নিজেরা কাপড় কিনে, বানিয়ে নিজেরা মডেল হচ্ছেন, বিক্রি করছেন। মেকাপ টিউটোরিয়াল করাচ্ছেন। এমনকি অনলাইনে জিমও করাচ্ছেন।
তিনি বলেন, চিরচেনা প্রেক্ষাপট পাল্টা যাওয়াটা বেশ নীরবেই ঘটে গেছে। নারীর এই অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কোনো ডোনারকে বিশেষ প্রজেক্ট প্ল্যান নিয়া আসতে হয়নি। আমি আজ সারাদিন ভেবেছি অনলাইনে এই ফিমেল লেবার মার্কেট নিয়ে, জাতীয় অর্থনীতিতে নারীদের এই অংশগ্রহণ কি স্বীকৃত পাবে। করোনার মতো মহামারীতে মানুষ ঘরে বসেই বিকল্প উপায়ে আয়ের কথা ভেবেছে। তাই এতোসব বিকল্প পেশা তৈরি হয়েছে গত দুবছরে। যা অনেকের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। জয়িতা ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফরোজা খান বলেন, ‘জয়িতা ফাউন্ডেশন ব্যবসা অনুকূল ও নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে কাজ করে। নারী উদ্যোক্তা সমিতির সদস্যগণ ব্যবসায় অর্জিত মুনাফা নিজ নিজ অবদান অনুযায়ী পেয়ে থাকেন।’
‘নারী উদ্যোক্তারা মূলত জয়িতার প্লাটফর্মে প্রত্যক্ষভাবে ব্যবসা করে থাকেন। আমরা উদ্যোক্তাদেরকে ব্যবসা পরিচালনায় ও পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় জ্ঞান-দক্ষতা প্রদান করে থাকি। এছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে পুঁজি যোগানের ক্ষেত্রে ঋণ সহায়তা প্রদান করি।’
অনলাইনে দেশি পণ্যের উদ্যোক্তা এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে উই উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)। উই’র প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, ‘ফেসবুকভিত্তিক এই প্ল্যাটফর্ম এখন দশ লাখ সদস্যের পরিবার। যাদের প্রায় সবাই দেশি পণ্যের উদ্যোক্তা। তারা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে এসেছে।’ ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা হতে নারীরা আরও বেশি এগিয়ে আসবেন বলে আশা করেন তিনি।
এ বিষয়ে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীন বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসৃত নীতি অনুসরণ করে নারীকে উন্নয়নের মূল¯্রােতে অন্তর্ভুক্ত করতে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। প্রায় ৪০টি ট্রেডে তৃণমূল নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থান শুরুর জন্য আমরা মূলধন সহায়তাও দিয়ে থাকি। সরকারের এসব সুযোগ সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি আমরা সহজ করে এনেছি। লালফিতার যে দৌরাত্ম এক সময় ছিলো, ঋণের টাকা পেতে অনেকবার ধর্ণা দিতে হতো, এখন সেই পরিস্থিতি নেই। এখন সর্বোচ্চ দু’বার যোগাযোগের মাধ্যমেই উপকারভোগী কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন।