৩৩ রুশ ধনকুবেরের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার নিষেধাজ্ঞা
রাশিদ রিয়াজ : ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের পর রাশিয়ার ৩৩ বিলিয়নিয়রের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে অস্ট্রেলিয়া। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছেন ইংল্যান্ডের ফুটবল ক্লাব চেলসির মালিক রোমান আব্রামোভিচও। এছাড়া এই ৩৩ ধনকুবেরের নিকট আত্মীয়রাও নিষেধাজ্ঞার অধীনে পড়বে বলে জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ডেইলি মেইল
বিবিসি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, আব্রামোভিচ ছাড়াও এই তালিকায় রয়েছেন অ্যালেক্সি মিলার, দিমিত্রি লেবেদেভ, সের্গেই চেমেজভ, নিকোলে তকারেভ, ইগোর শুভালভ ও কিরিল দিমিত্রিয়েভের মতো প্রায় তিন ডজন রুশ বিলিয়নিয়র। সোমবার এক ঘোষণায় অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে, যেসব রুশ ধনকুবের ব্যাপক ব্যাক্তিগত সম্পদের মালিক এবং রাশিয়ার জন্য তারা অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ তাদের টার্গেট করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে অস্ট্রেলিয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। অস্ট্রেলিয়ার সরকার ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও জনগনের প্রতি শক্ত সমর্থন জানিয়ে এধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে রুশ শীর্ষ ধনীরা যুদ্ধের কারণে ইতিমধ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ হারিয়েছেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা ও রুশ মুদ্রা রুবলের দরপতনের কারণে এসব ধনীরা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। এর পরিমান কম করে হলেও ৮০ বিলিয়ন ডলার বলে সিএনবিসি জানিয়েছে। এই ক্ষতি বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ৯০ টাকা ধরে)। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, এই ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৮ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বা ৭ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা।
ফোর্বস ম্যাগাজিন জানিয়েছে, প্রথম কয়েক দিনেই রাশিয়ার ১১৬ জন অতিধনী ১২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার বা ১১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার সম্পদ হারান। এর মধ্যে ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রথম দিনেই প্রায় ৭ হাজার ১০০ কোটি ডলার কমেছে। ওই দিন রাশিয়ার শেয়ারবাজারের প্রধান মায়েক্স ৩৩ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুশ মুদ্রা রুবেলের দাম কমে রেকর্ড নি¤œ পর্যায়ে নেমে যায়। একই সঙ্গে রুশ ধনীদের কারো কারো প্রমোদতরী আটকের ঘটনাও ঘটেছে। উজবেক বংশোদ্ভূত রুশ ধনকুবের আলিশার উসমানভের ৫০০ ফুট দৈর্ঘ্যের ‘দিলবার’, যুক্তরাজ্যের চেলসি ফুটবল ক্লাবের মালিক রোমান আব্রামোভিচের ৪৬০ ফুট দৈর্ঘ্যের ‘সোলারিচ’ ও রোজনেফট তেল কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইগর সেচিনের ২৮০ ফুটের ‘আমোর ভেলো’ নামের তিনটি প্রমোদতরি রয়েছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর ধারাবাহিক নিষেধাজ্ঞা আরোপে দেশটিতে অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। যা দেশটির অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে পারে। কারণ, পশ্চিমারা রাশিয়ার পাশাপাশি দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ অতিধনীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ অব্যাহত রেখেছে। রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় ২০ জন বিলিয়নিয়ার, তথা অতিধনীর সম্পদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খোয়া গেছে। প্রসঙ্গত, ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বা এর চেয়ে বেশি পরিমাণ ধনসম্পদের মালিকদের বিলিয়নিয়ার বলা হয়। পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে রাশিয়ান ধনীদের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তারা রুশ অতিধনীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার লক্ষ্যে একটি নতুন বৈশ্বিক টাস্কফোর্স গঠনের কথাও জানিয়েছে। রুশ বিশেষজ্ঞরাও ইতিমধ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আর্থিক প্রভাব শুরু হয়েছে।
রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় তেল কোম্পানি লুকঅয়েলের প্রেসিডেন্ট ভ্যাগিত আলেকপেরভ সবচেয়ে বেশি সম্পদ হারিয়েছেন। ৬০ শতাংশ সম্পদ খোয়ানোর কারণে তিনি ব্লুমবার্গের বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স তথা তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। আজারবাইজানি বংশোদ্ভূত এই ধনকুবের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ১ হাজার ৫০ কোটি ডলারের সম্পদ হারিয়েছেন। তিনি ফোর্বস–এর বিলিয়নিয়ার তালিকায় ৬৬তম স্থানে রয়েছেন। যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ভ্লাদিমির পোটানিনের সম্পদের প্রায় এক–চতুর্থাংশই খোয়া গেছে। তাঁর সম্পদ কমে এখন ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। তিনি ফোর্বসের তালিকায় ৫৫তম ধনী। রাশিয়ার মেগাফোন, ইউএসএম হোল্ডিংস ও উদোকান কপারের মালিক উসমানভের সম্পদের পরিমাণ ১৭০ কোটি ডলার কমে ১ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারে নেমে গেছে। তিনি ফোর্বস–এর বৈশ্বিক ধনী তালিকায় ৯৯তম স্থানে রয়েছেন। রাশিয়ার অতিধনীদের আরও অনেকেই চরমভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তেমনই একজন ভলগা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং গ্যাস কোম্পানি নোভেটেক ও সিবুর হোল্ডিংয়ের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য গেনাদি টিমচেঙ্কো। তাঁর সম্পদ ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার থেকে রীতিমতো অর্ধেক কমে ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারে নেমে গেছে। ফোর্বসএর তালিকায় তিনি ৭৮তম স্থানে আছেন। একই সঙ্গে নোভাটেকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) লিওনিদ মিখেলসনের সম্পদও ১ হাজার ৫০ কোটি ডলার কমে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার হয়েছে।
অন্যান্য অতিধনীর মধ্যে রুশ খনি-ম্যাগনেট খ্যাত আলেক্সি মোর্দাশভের সম্পদের পরিমাণ ৫৬০ কোটি ডলার কমে ২ হাজর ২০০ কোটি ডলারে নেমেছে। ফোর্বস-এর ইনডেক্সে তাঁর নাম রয়েছে ৫১তম স্থানে। যুক্তরাজ্যের চেলসি ফুটবল ক্লাবের মালিক ও রুশ ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচ প্রায় ২০০ কোটি ডলারের সম্পদ খুইয়েছেন। এর মধ্যে তার ৪৬০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি সুপার ইয়ট রয়েছে, যেটির দাম ৬০ কোটি ডলার। স্পেনের একটি শিপইয়ার্ড থেকে ইয়টটি জব্দ করা হয়। সেটি ২০২১ সালে মেরামতের জন্য সেখানে নেওয়া হয়েছিল। তিনি এখন বিশ্বের ১৪২তম অতিধনী। রাশিয়ার বহুজাতিক শিল্পগোষ্ঠী আলফা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মিখাইল ফ্রিডম্যান ২৩০ কোটি ডলারের সম্পদ খুইয়েছেন।
ফোর্বস ম্যাগাজিনের তালিকা অনুযায়ী মিখাইল ফ্রিডম্যান এখন বিশ্বের ১২৮তম ধনী। ফোর্বস আরো বলছে তাদের বিলিয়নিয়ার তালিকা থেকে গত কয়েক সপ্তাহে রাশিয়ার অন্তত এক ডজন অতিধনীর নাম বাদ পড়েছে। অর্থাৎ এসব অতিধনীর সম্পদের পরিমাণ কমে ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে গেছে।
একই সঙ্গে একের পর এক নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার রিজার্ভের ৩০ হাজার কোটি ডলার আটকে গেছে। রাশিয়ার প্রায় অর্ধেক স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিভিন্ন দেশে জব্দ হয়ে আছে। এত দিন একের পর এক সম্পদ জব্দের তথ্য এলেও রাশিয়ার পক্ষ থেকে মোট পরিমাণ জানানো হয়নি।
তবে অবশেষে এ নিয়ে মুখ খুলেছেন দেশটির অর্থমন্ত্রী আন্তন সিলুয়ানভ। রুশ অর্থমন্ত্রী আন্তন সিলুয়ানভ বলেন, আমাদের মোট রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ৬৪০ বিলিয়ন (৬৪ হাজার কোটি) মার্কিন ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন (৩০ হাজার) ডলার রিজার্ভ এখন আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। রোববার রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই তথ্য জানান তিনি।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করে রুশ অর্থমন্ত্রী বলেন, ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশ বানিয়েছে পশ্চিমারা। কিন্তু এতে রাশিয়ার মনোবল নষ্ট হবে না।
সিলুয়ানভ বলেন, পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক সীমিত করার জন্য এখন চীনের ওপর চাপ দিচ্ছে। যাতে করে চীনা ইউয়ানে লেনদেন করার ক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রবেশাধিকার বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু আমি মনে করি, চীনের সঙ্গে আমাদের অংশীদারত্ব এখনো অনেক মজবুত। চীন থেকে আমরা যে সহযোগিতা পেয়েছি, তা বজায় থাকবে। বরং এটি আরও বৃদ্ধি পাবে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কাজে আসবে না।
রাশিয়াকে একঘরে করার জন্য আন্তর্জাতিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) থেকে বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ ছাড়া দেশে দেশে রাশিয়ার মালিকানাধীন বেশ কিছু সম্পদও জব্দ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশটির মোট রিজার্ভের প্রায় অর্ধেকই এখন অকার্যকর অবস্থায় আছে। অবশ্য রাশিয়াও তার অর্থনীতিকে সচল রাখার উপায় খুঁজতে কাজ করছে। রাশিয়ান ব্যাংকগুলোর জন্য সুইফটের বিকল্প হিসেবে দেশটি এখন চায়নিজ ক্রস বর্ডার ইন্টার ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেমকে (সিআইপিএস) ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া গ্রাহকদের অর্থ লেনদেনে সুবিধা দিতে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট খোলার পরামর্শ দিয়েছে দেশটির একাধিক ব্যাংক।