মূল্যস্ফীতিতে উদ্বেগ বাড়ছে
মো. আখতারুজ্জামান : প্রতিনিয়ত বাড়ছে দ্রব্যমূল্যের দাম। নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করছে মূল্যস্ফীতিতে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ওপরে চলে গেছে। করোনার শুরু থেকে কর্ম হারাতে শুরু করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। এতে নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, ভর্তুকি ও মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনা করাই এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ। তবে এতো কিছুর মধ্যেও আমাদের রপ্তানি আয়ের সূচক ঊর্ধ্বমুখী। অন্যদিকে আমদানিকৃত প্রায় প্রত্যেকটি পণ্যের দাম বেড়েছে।
গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার সংশোধন করে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। যদিও অর্থবছরের শুরুতে এ হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত ওই ঘোষণার মধ্যে রাখা যাচ্ছে না। সংশোধিত মূল্যস্ফীতির হার দশমিক ৪ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
সর্বশেষ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশে। জানুয়ারি মাসে এ হার ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এছাড়া খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ, যা জানুয়ারিতে ছিল ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।
বুধবার সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, আশপাশে আমাদের যেসব দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ প্রতিটি দেশের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি মিলিয়ে দেখুন, সেখানেও মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে।
আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। ফলে আগামী দিনগুলোতে আরও মূল্যস্ফীতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন। এর নিয়ন্ত্রণ হাতে নেই। এটি বিশ্ব পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি এ মুহূর্তে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের অতিরিক্ত মূল্যের চাপে আছে নিম্ন আয়ের মানুষ। কারণ খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেই তাদের মোট আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায়। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ট্রাকে মানুষের দীর্ঘ লাইন পরিস্থিতির বড় প্রমাণ। সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, তরিতরকারি, মাছ, মাংস, ডিমসহ অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয়েক মাস ধরে চড়া। কোনো কোনো পণ্যের দাম ইউরোপ এবং আমেরিকার চেয়েও বেশি।
গত দুবছর করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে অর্থনীতি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সেখান থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসার আগেই শুরু হয় রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ। এর প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ফলে এ খাতে ভর্তুকির অঙ্ক বাড়বে। এ ছাড়া বেড়েছে সার ও খাদ্যপণ্যের দামও। আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম বাড়লেও সরকার কৃষকের সারের মূল্য বৃদ্ধি করেনি। কৃষককে দেওয়া হচ্ছে ভর্তুকি মূল্যে সার। ফলে বড় ধরনের ভর্তুকি এ খাতেও গুনতে হবে।
এ ছাড়া রেমিটেন্স প্রভাব ঠিক রাখতে সরকার নিজেই এ খাতে প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে ২.৫ শতাংশে উন্নীত করেছে। এখানে ভর্তুকি গুনতে হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতেও ভর্তুকি বাড়বে। বর্তমানে এ খাতে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আছে।
পাশাপাশি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এর প্রভাব বিদ্যুৎ খাতে পড়েছে। এ খাতেও আরও দুই হাজার কোটি টাকা বাড়ানোর হিসাব করছে অর্থ বিভাগ। আর এলএনজি খাতে চলতি অর্থবছরে ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। এদিকে করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি খাত নিয়ে নানা শঙ্কা থাকলেও অনেকটাই চাঙা আছে রপ্তানি খাত। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে গত ফেব্রুয়ারিতে আয় বেড়েছে ৩৪ শতাংশ।
অন্যদিকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪২৯ কোটি ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার। আগের বছরের ফেব্রুয়ারিতে যা ৩১৯ কোটি ডলার ছিল। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ৩৩৮৪ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। সেই হিসাবে আট মাসের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এগিয়ে আছে রপ্তানি খাত। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে রপ্তানি হয়েছিল ২৫৮৬ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পণ্য।
বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম জানান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বেশ আতঙ্কের মধ্যে আছেন। আমাদের যে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ, এটি আরও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু বিশ্ববাজারে কাঁচামালের মূল্য ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক প্রবৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, চীন বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কয়লা দিয়ে। সম্প্রতি কয়লা নিয়ে চীনে সমস্যা হচ্ছে।
এ জন্য তাদের বিদ্যুৎ নিয়ে জটিলতায় পড়ছে মিলগুলো। সেখান থেকে নতুন বায়ার বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকে এ দেশে এসে অর্ডার দিচ্ছে। যারা আগে কখনো বাংলাদেশে আসেনি। এজন্য আমাদের অর্ডারও বাড়ছে।